ডিপারচারস-জীবন ও মৃত্যুর অপার্থিব সম্পর্ক

ডিপারচারস মুভি রিভিউ-জীবন ও মৃত্যুর অপার্থিব সম্পর্ক-departures movie review

 

Departures Movie Review in Bangla

জন্ম এবং মৃত্যু; দুইটি বিপরীত শব্দ।দুটি শব্দই মানুষের জীবনে প্রবেশ করে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে।একটি শব্দ জীবন দান করে; অপরটি জীবন কেড়ে নেয়।জন্মের পর থেকে আমাদের চিন্তা থাকে কিভাবে বেঁচে থাকা যায়? ঘাত- প্রতিঘাত, সম্মান- অসম্মান সব পেরিয়ে কীভাবে বেঁচে থাকা যায়? কীভাবে ধীরে ধীরে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে হয়? কারণ বেঁচে থাকা আর মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা তো একই কথা।যাইহোক, এবার মুভির দিকে আসা যাক-

ডিপারচারস; যার অর্থ মৃত ব্যাক্তির আত্মাকে স্বর্গ যাত্রায় পাঠানো। ২০০৮ সালে মুক্তি পাওয়া ইউযিরো টাকিটা পরিচালিত এই সিনেমাটি সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী।নাটকীয়তা বর্জিত একঘেয়েমীহীন অসাধারণ একটি মুভি।স্বাভাবিক জাপানিজ সিনেমার বাইরে এ যেন অন্যকিছু।এ যেন সম্পর্কের গল্প; জন্ম, মৃত্যু, প্রেম, ভালবাসার সম্পর্কের সাথে এ যেন অন্য রকমের মিশেল।

দাইগো; একজন সেলোবাদক।সেলো বাজানো যেন তার ভালবাসা! এমনকি নিজের সব সম্বল বিক্রি করে সে সেলো কিনে।কিন্তু একসময় সে চাকরীচ্যুত হয়।তখন স্ত্রী মিকাকে নিয়ে সে নিজ শহরে ফিরে আসে।এবং কাজ খুঁজতে থাকে।একদিন বিজ্ঞাপনে ট্রাভেল এজেন্সির চাকরী দেখে সে যোগদান করতে যায়।কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখে সেটা মৃতদেহ সাজিয়ে দেবার প্রতিষ্ঠান।কাজটি প্রথম প্রথম তার ঘৃণার বস্তু হলেও ধীরে ধীরে সে অভ্যস্ত হয়ে যায়।তা ছাড়া আর উপায়টাই বা কি!

এই চাকরী একসময় তার ঘৃণার বস্তু হলেও পরবর্তীতে তা ভালবাসায় রুপান্তরিত হয়।অন্যের মৃত্যুই যেন তার চাকরির ভরসা।অন্যের মৃত্যুর উপর এই চাকরি নির্ভর করে।মৃত ব্যাক্তির আত্মীয়- পরিজনদের সামনে সে খুব যত্নের সাহায্যে কাজটি করে।সম্মান ও ভালবাসার সাহায্যে দাইগো এই সম্মানজনক কাজটি করে থাকে।অনেক সময় নিয়ে, ধীরে ধীরে, যত্ন সহকারে সৎকার সাজিয়ে দেওয়ার কথা কারো মাথায় আসার কথা নয়।সমাজের লোক যেখানে এই কাজটিকে অবজ্ঞার চোখে দেখে; সেটাকেই পরম যত্নে দাইগো ভালবাসায় ভরিয়ে দেয়।

দাইগোর কাজের কথা লোকে- মুখে ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে সবাই তাকে অবজ্ঞার চোখে দেখতে থাকে।এমনকি ভালবাসার স্ত্রী মিকাও তাকে ঘৃণা করতে শুরু করে।সে দাইগোকে চাকরীটা ছেড়ে দিতে বলে।কিন্তু দাইগো তা পারেনা।সে কাজটিকে ভালবেসে ফেলেছে।দাইগো স্ত্রীর কথা রাখতে পারেনা।

মিকা তাকে ছেড়ে চলে যায়।আসলে মিকা দাইগোর কোনো কাজই পছন্দ করত না।সেলো বাজানো থেকে শুরু করে সবকিছু্তেই সে অনিচ্ছাকৃতভাবে দাইগোর পাশে থেকেছিল।একটাও মন থেকে সে চাইত না, শুধু দাইগো কষ্ট পাবে তাই সে রাজি থাকত।কিন্তু আর না; মিকা চলে যায়।দাইগো ভয়ঙ্কর নিঃসঙ্গতার ভেতর পচে মরতে থাকে।কিন্তু তার কাজে সে নতুনভাবে বেঁচে উঠে।

সময়ের সাথে সাথে মিকাও ফিরে আসে।পরিচিতজনেরাও কাজ সম্পর্কে তাদের ভুল ধারণা বুঝতে পারে।

একদিন খবর আসে, দাইগোর বাবা মারা গেছে।দাইগো তার বাবাকে সহ্য করতে পারত না।কারণ তার বাবা ছোটবেলায় তার মা ও তাকে ছেড়ে চলে যায় এবং আরেকজনকে বিয়ে করে সংসার সাজায়।কিন্তু কিছু কিছু স্মৃতি কখনো মরেনা।দাইগোর সাথেও তার বাবার কিছু স্মৃতি আছে; যা সে কখনোই ভুলতে পারে না।কিন্তু দাইগো বাবার লাশ গহণ করতে যেতে অস্বীকৃতি জানায়।মিকা তাকে অনুরোধ করে যাতে সে বাবাকে শেষযাত্রার জন্য তৈরি করে দেয়।

শেষ সময়ে এসে দাইগো প্রবলভাবে কেঁদে উঠে।বাবার হাতে সে ছোটবেলার পাথর- চিঠি দেখতে পায়।যা দাইগো আর বাবা সমুদ্রের পাশে বসে দেখত।বাবার প্রতি তার সব রাগ যেন ধুলোয় মিশে যায়।মৃত ব্যাক্তির প্রতি কারো কোন রাগ থাকেনা, দাইগোরও নেই।ররং সব রাগ ভালবাসা হয়ে ঝরে পড়ে।

পরিশেষে,

সিনেমাটির মুল প্রসঙ্গ হচ্ছে জীবন ও মৃত্যু।সিনেমায় বারবার মৃত্যুর কাছে গিয়েও শেষে নিরুত্তাপ, নিরাবেগ, রহস্যময়, দ্বান্ধিক পরিবেশেই রেখে দেয় আমাদের।জাপানী ঐতিহ্যিক জীবনবোধ ও লোকাচারের অসাধারণ সংমিশ্রণ এই সিনেমাতে দেখা যায়।

দাইগো যখন সেলো বাজাত; তখন সেলোর সুরে যেন আমাদের ভ্রম হয়।আমরা কোথায়? জন্মে নাকি মৃত্যুতে? জন্ম আর মৃত্যুকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে রেখে আমাদের ভাবাতে থাকে দাইগোর শিহরণ জাগা সেলোর সুর।

মৃদু, হালকা, থমথমে পরিবেশে আমরা হারিয়ে যেতে থাকি সময়ের গতিবেগের সাথে সাথে।এই সিনেমা যেন গুঢ় সত্য; যার অর্থ খুজতে খুজতে আমরা হারিয়ে যায়।কিন্তু এই সত্য অসমাপ্তই থেকে যায়।

সিনেমায় পাথর- চিঠি একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ।যেখানে পাথরের কাঠামো দেখে মনের খোজ মিলত।মসৃণ আর অমসৃণ পাথর! ঠিক তেমনিভাবে ডিপারচারস মুভিটিও আমাদের হাতে পাথর- চিঠি ধরিয়ে দিয়েছে।কিছু মসৃণ আবার কিছু অমসৃণ!যার সবকিছু দ্বান্ধিক দ্বিধায় ভরা!


আরো পড়ুনঃ

চারুলতা;সত্যজিৎ রায়ের অমর সৃষ্টি

উদারিং হাইটস 2011;মনস্তাত্বিক দ্বান্ধিকতার অভূতপুর্ব আখ্যান

মেঘে ঢাকা তারা; এক বিদ্রোহী সত্ত্বা

এ বিউটিফুল মাইন্ড; ভালবাসার রহস্যময় সমীকরণ

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url