উদারিং হাইটস
প্রেম; বিচিত্র এক অনুভুতি।অদ্ভুত, রহস্যময় এই অনুভূতি কখনো আলোকিত কখনো
বা নিকষ কালো অন্ধকারের মত পাল্টায়।দেহের সবচেয়ে দুর্বল ভালবাসার জায়গাতেই এটা আঘাত
হানে।প্রকৃতির এই অদ্ভুতুড়ে ধোয়াশার কোনো সীমাবদ্ধতা নেই, কোনো নিয়ম নেই।
এমিলি ব্রনটি; ঊনবিংশ শতকে জন্মগ্রহণ করা এক বিস্ময়।যার হাতের মুগ্ধতায়
রচিত হয়েছে উদারিং হাইটস।প্রেম, ঘৃণা, হিংসা, প্রতিশোধ নিয়েই এই অভূতপূর্ব আখ্যান।
১৮১৮ সালে ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি।বাকি দুই বোন শার্লট, এমি ও
ছিলেন সাহিত্যিক।সাহিত্যিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করা এই লেখিকার জীবন ছিল নানা দুর্যোগতায়
ভরপুর।সমাজের অন্যান্যদের তুলনায় কিছুটা আলাদা থাকার কারণে ভোগ-ভোগান্তির শিকার তো
ছিলই।সেলুলয়েডের ফিতায় এই লেখিকার মুগ্ধতা যখন প্রকাশ পায় তখন সেটা অসাধারণত্বকেও ছাড়িয়ে
গেছে।এখন সিনেমার দিকে আসা যাক-
ইয়র্কশায়ারের বিশাল পাহাড়ি এলাকাজুড়ে এক জমিদার বাড়ি; উদারিং হাইটস।বাড়ির
মালিক জমিদার মি. আর্নশ।এক শিশিরভেজা কুয়াশার রাতে বাড়িতে এক অতিথিকে নিয়ে আসেন তিনি।রাস্তায়
বেড়ে উঠা অভিভাবকহীন কৃষ্ণাঙ্গ হিথক্লিফ যেন নতুন জীবনের আভাস পায়।নিজের সন্তানের মতোই
আদর- ভালবাসা দিয়ে লালন- পালন করতে থাকেন মি. আর্নশ।এমনকি ভুতুড়ে এবং অতিপ্রাকৃতিক এই বাড়িতে
হিথক্লিফের সর্বক্ষণের সাথী হন মি. আর্নশের মেয়ে ক্যাথরিন।
দুরন্ত, প্রাণচঞ্চল ক্যাথির সাথে কৃষ্ণাঙ্গ এই বালকের মাঝে যেন অভূতপূর্ব
এক সম্পর্ক গড়ে উঠে।যেটা নিত্যকার সাধারণ ভাই- বোনের সম্পর্ককেও ছাড়িয়ে যায়।ক্যাথির
মাঝেই মা হারা হিথক্লিফ ভালবাসার ছন্দ খুঁজে পায়।কাজ ফেলে দুজনের একসাথে দৌড়ের প্রতিযোগিতায়
নামা, কনকনে শীতে খোলা চুলের ক্যাথিকে মায়াভরে হিথক্লিফের অকারণে চেয়ে থাকা; সব যেন
পরিকল্পিত। ভুতুড়ে, প্রাণহীন, আলোহীন অন্ধকারের এই আভাস বর্তমানে সবকিছু ভুলিতে দিতে
প্রস্তুত।
কিন্তু সব নৌকার কাছেই ঝড় আসে; উড়িয়ে নিয়ে যায় নৌকাটিকে।তেমনি ক্যাথি- হিথক্লিফের
এই অনাকাঙ্ক্ষিত ভালবাসাতেও অনাকাঙ্ক্ষিত একজন প্রবেশ করে।হিন্ডলেই; আর্নশ পরিবারের
আরেক ছেলে, ক্যাথির ভাই।কৃষ্ণাঙ্গ হিথক্লিফের প্রতি তার কোনো সহানূভূতি তো ছিলই না,
উল্টো সে ছিল চোখের বিষ।এবং তার সব ক্রোধ ঝেড়ে ফেলার সময়ও এসে যায় পিতা মি. আর্নশের
মৃত্যুতে।
কাকতালীয়ভাবে, কোনো এক রাতে দুই ভালবাসার সাথী হাজির হয় থ্রাসক্রশগ্রাঞ্জ এ।পাহারাদার
ককুরের কামড় খাওয়ার কারণে থ্রাসক্রশগ্রাঞ্জ পরিবার তাদের ভেতরে নিয়ে যায়।এ যেন আরেক
অট্টালিকা।ধীরে ধীরে দুই বাড়ির মধ্যে একটি সম্পর্ক তৈরি হয়।এমনকি থ্রাসক্রশগ্রাঞ্জের
ছেলে লিনটনের মায়ায় জড়িয়ে পড়ে ক্যাথি।
একদিকে চঞ্চল, ভবঘুরে হিথক্লিফ; আরেকদিকে জমিদারপুত্র লিনটন।ক্যাথির ছোট্ট
হৃদয়টা দ্বন্ধে ভরপুর হয়ে যায়।স্বার্থপর ক্যাথি ঝুঁকে পড়ে লিনটনের প্রতি; কিন্তু হৃদয়ের
কোনো এক জায়গায় সে আঘাত পায় হিথক্লিফের জন্য।তবু সব ভুলে থাকতে চায় সে।কৃষ্ণাঙ্গ হিথক্লিফকে
এড়িয়ে লিনটনের কাঁধে মাথা রাখতে চায় সে।সিদ্ধান্তহীন ক্যাথির দুটি মানুষের প্রতি অনুভুতি
যেন দ্বান্ধিক রহস্যময়তায় ভরপুর হয়ে যায়।
বুঝতে পারে হিথক্লিফ।রাগে, অভিমানে, কষ্টে সে তার প্রেমকে ভুলে প্রেমিকাকে
প্রাধান্য দিয়ে চলে চায় আর্নশ পরিবার ছেড়ে।আর ক্যাথি; সে লিনটনকে বিয়ে করে সুখের সংসার
সাজায়।
কিন্তু প্রেম যে ক্ষণিকের আকর্ষণ নয়; সারাজীবনের আকর্ষণ।সে আকর্ষণকে ভুলে
আর কতদিন থাকতে পারবে হিথক্লিফ? ফিরে আসে হিথক্লিফ; প্রেয়সীকে একটিবার দেখার জন্য।ততদিনে
ক্যাথির সুখের সংসার আলোকিত করে কেউ আসতে চাচ্ছে।অন্যদিকে, অনেকদিন পর হিথক্লিফকে দেখে
লিনটনের বোন ইসাবেলার মধ্যে পরিবর্তন দেখা যায়।সে প্রেমে পড়ে যায় হিথক্লিফের।কিন্তু
হিথক্লিফের সেদিকে মন নেই; সে তো তার প্রেমের পেছনেই ব্যস্ত।এদিকে স্বামী লিনটনও এই
অনাকাঙ্ক্ষিত আগন্তুকের সাথে স্ত্রীর মেলামেশা পছন্দ করতে পারছে না।বারবার সে সন্দিহান
থাকে; এই বুঝি তারা পালিয়ে গেল।
জীবনের বিশেষ কিছু মুহুর্তে আত্মার বন্ধনই অনেক বেশি মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়।তেমনিভাবে,
মৃত্যুর আগ মুহুর্তে ক্যাথরিন সেটা অনুভব করে।সন্তানসম্ভবা ক্যাথির দুর্বল হৃদয়ের দুর্বলতায়
আবার কিছু একটা আঘাত হানে।শারীরিক এবং মানসিকভাবে ভেঙে পড়া ক্যাথির ভেতরে হাহাকারের
ছন্দ বেজে উঠে।শেষ মুহুর্তে ক্যাথি বুঝতে পারে বিচিত্র সেই অনুভুতির কথা, যা সে এতদিন
বুঝতে পারেনি।ক্যাথি নিজ স্বরুপে ফিরে আসে।ভালবাসার যে বিশালতা, ঐশ্বরিক ক্ষমতা সেটা
সে বুঝতে পারে।হিথক্লিফের প্রতি যে জায়গাটা ছিল সেটা আজ পরিপূর্ণ, কালের আবর্তনে হারিয়ে
যায়নি।
কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে।মানুষের মত ভাগ্য এতটা সহনশীল না, ভাগ্য এটা
মেনে নিতে পারেনি।ক্যাথি মারা যায় এক বুক অশান্ত প্রশ্ন নিয়ে, অগোছালো হৃদয়বিদারক স্মৃতি
নিয়ে।ইহকালীন এই বিচ্ছেদকে হিথক্লিফ মেনে নিতে পারেনা।সে বলে উঠে,
আমার আত্মা ছাড়া আমি বাঁচবো কি করে?
প্রচন্ড একপাক্ষিক ও আত্মকেন্দ্রিক হিথক্লিফ সেই শান্ত শিশুটি আর নেই।প্রতিশোধের
আগুনে জ্বলতে থাকে সে।প্রিয়তমার এই মৃত্যু তাকে বারবার ভেঙে গুড়িয়ে দিতে থাকে।সে আর্নশ
পরিবারে ফিরে যায় আবার; ততদিনে সেটা মদ্যপানের আস্তানা।উদারিং হাইটস কিনে ফেলে সে।এবং
ইসাবেলাকে বিয়ে করে।ইসাবেলা যেন জুয়ার খেলা হয়ে দাঁড়ায়; প্রিয়তমার মৃত্যুকে মানতে না
পেরে সব রাগ সে ইসাবেলার উপর ঝাড়ে।প্রতিশোধপরায়ণ হিথক্লিফ এখন কাউকেই চিনেনা।
দৃশ্যের শেষে আধো কুয়াশায় হিথক্লিফকে দৌড়াতে দেখা যায়।যেন সে আবার ভালবাসাহীন
অনাথ সে আগের শিশুতে ফিরে যাচ্ছে।যাকে মি. আর্নশ এনেছিল; সেখানেই সে পাগলের মত ছুটছে
ভালবাসা খুজতে।কেন যেন এই সিনেমার কোনো শেষ নেই।অদ্ভুত এক সমাপ্তি; যার কোনো শুরুও নেই,
শেষও নেই।পরিশেষে কাউকেই বিচারের কাঠগড়ায় দাড়াতে হয়নি, আলো অন্ধকারের সংমিশ্রণেই এটি ধোঁয়াশা হয়ে থেকে যায়।
পরিশেষে,
পুরো সিনেমাজুড়ে হিথক্লিফ ভালবাসার পেছনেই ছুটেছে।আত্মিক, স্বর্গীয় প্রেমের
পেছনে সে সারাজীবন ছুটেছে।একসময় পেয়েও ছিল।কিন্তু প্রকৃতির নির্দয় নিয়ম সেটা কেড়ে নেয়।তার
ভালবাসার ক্যাথিকে সে হারায়, চিরজীবনের জন্য।ক্যাথিও ভালবেসেছিল হিথক্লিফকে।কিন্তু তার দ্বান্ধিক হৃদয় সিদ্ধান্তহীনতায় নেতিয়ে পড়ে।হিথক্লিফকে এখানে দেখানো হয়েছে
আলো আর অন্ধকারের মত।যার নেতিবাচক প্রতিশোধপরায়ণ দিকগুলোতেই যেন ইতিবাচকতা ভেসে উঠে।মনস্তাত্বিক
দ্বন্ধের অসাধারণ এই সিনেমা আমাদের মানবীয় আবেগকে চিরাচরিত নিয়ম থেকে অন্যভাবে ভাবাতে
শেখায়।শেষ পর্যন্ত, শেষ হয়েও যেন এটা শেষ না; এ যেন আড়ালের গল্প।