সংস্কৃতি ও সভ্যতার মধ্যে পার্থক্য ও সম্পর্ক
সংস্কৃতি ও সভ্যতার মধ্যে পার্থক্য ও সম্পর্ক
সংস্কৃতি ও সভ্যতার মধ্যে পার্থক্য ও সম্পর্ক আলোচনার পূর্বে ২টি বিষয় সম্পর্কে ধারণা নিই। এই দুইটি বিষয় হল সংস্কৃতির সংজ্ঞা ও সংস্কৃতির উপাদান।এইসব বিষয় সম্পর্কে ধারণা নিলে সভ্যতা ও সংস্কৃতির মধ্যে পার্থক্য ও সম্পর্ক নিরুপণ করা সহজ হবে।
সংস্কৃতির সংজ্ঞাঃ
সমাজবিজ্ঞানী, দার্শনিক, নৃবিজ্ঞানী, সাহিত্যিক ও মার্কসবাদীরা ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ হতে সংস্কৃতির মূল বৈশিষ্ট্য বোঝার চেষ্টা করেছেন।এককথায় সংস্কৃতির সংজ্ঞা হল মানবসৃষ্টির সবকিছু। অর্থাৎ মানবসৃষ্টির সবকিছুই হল সংস্কৃতি।সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল সংস্কৃতি বংশ পরম্পরা উত্তরাধিকারসূত্রে মানব সমাজে বর্তায়।
সংস্কৃতির উপাদানঃ
প্রকৃতির সবকিছুই সংস্কৃতির উপাদান নয়। মানুষের কাছে প্রয়োজনীয় হলেই কেবল সংস্কৃতির উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়। যেমনঃ গভীর অরণ্যের ভেতরে সেগুন গাছ সংস্কৃতির উপাদান নয়। তবে অরণ্য হতে সেগুন গাছ সংগ্রহ করে আসবাবপত্র ও গৃহ নির্মাণ করলে তখন আবার সংস্কৃতির উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়।
সংস্কৃতির উপাদান দুই প্রকার হয়ে থাকে। একটি হচ্ছে বস্তুগত সংস্কৃতি ও অপরটি হল অবস্তুগত সংস্কৃতি।
বস্তুগত সংস্কৃতি কিঃ
মানুষের সংস্কৃতি যখন বস্তুগত আকারে প্রকাশ লাভ করে তখন তাকে বস্তুগত সংস্কৃতি বলে।যেমনঃ ইট, পাথর ও দেয়াল দিয়ে নির্মিত স্কুল, যার উপর মানুষ মূল্যবোধ আরোপ করে।
অবস্তুগত সংস্কৃতি বা অধরা সংস্কৃতি কিঃ
মানুষের সংস্কৃতি যখন অনুভূতি আকারে প্রকাশ লাভ করে তখন তাকে অবস্তুগত সংস্কৃতি বা অধরা সংস্কৃতি বলে।যেমনঃ সাহিত্য, নাট্যকলা, শিল্পকলা,সঙ্গীত ইত্যাদি।
সংস্কৃতি ও সভ্যতার মধ্যে পার্থক্যঃ
সংস্কৃতি ও সভ্যতার মধ্যে সম্পর্ক থাকলেও বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী,নৃবিজ্ঞানী ও দার্শনিক সংস্কৃতি ও সভ্যতার মধ্যে পার্থক্য নিরুপণ করেছেন।তাদের সূত্র ধরেই নিচে সংস্কৃতি ও সভ্যতার মধ্যে পার্থক্য উদাহারণসহ তুলে ধরা হলঃ
১।সংস্কৃতি হচ্ছে অভ্যন্তরীণ ও মনোজগতের বিষয়। সভ্যতা হচ্ছে বাহ্যিক ও যান্ত্রিক বিষয়।
২।আত্মিক অগ্রগতি হচ্ছে সংস্কৃতির সূচক। আর বস্তুগত অগ্রগতি হচ্ছে সভ্যতার সূচক।
৩।প্রত্যেক জাতি সংস্কৃতির ক্ষেত্রে রক্ষণশীল মনোভাব পোষণ করে।আর সভ্যতার ক্ষেত্রে মানবজাতি রক্ষণশীল মনোভাব পোষণ করে না।
৪।সংস্কৃতি হলো উপলদ্ধির বিষয়। সভ্যতা হলো প্রায়োগিক ও বাস্তব।
৫।নিরবিচ্ছিন্ন অগ্রগতিই হচ্ছে সভ্যতার প্রধান বৈশিষ্ট্য। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এ কথা প্রযোজ্য নয়।
৬।সংস্কৃতি হল অভীষ্ট লক্ষ্য। সভ্যতা হল অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের উপায়।
৭।সভ্যতা অপেক্ষা সংস্কৃতি অধিকতর স্থায়ীত্বশীল।
৮।সংস্কৃতির উপাদানসমূহ আয়ত্ত্ব করা মোটেই সহজ নয়। অন্যদিকে সভ্যতার উপাদানসমূহ আয়ত্ত্ব করা সংস্কৃতি অপেক্ষা সহজ।যেমনঃ সামান্য ব্যবহারিক জ্ঞান থাকলে মানুষ আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে পারে। অপরদিকে সামান্য জ্ঞান দিয়ে সাহিত্যিক, শিল্পী বা দার্শনিক হওয়া যায় না।
৯।সংস্কৃতি পরিমাপের সর্বজনস্বীকৃত মাপকাঠি নেই। তবে কল্পনা ও রুচি এবং মানসিকতার নিরিখে সংস্কৃতিকে বিচার করা যায়। সভ্যতা পরিমাপের মাপকাঠি রয়েছে। বাস্তব উপযোগিতার নিরিখে সভ্যতাকে বিচার করা যায়। যেমনঃ পূর্বের দিনের রেলগাড়ির চেয়ে বর্তমান দিনের রেলগাড়ি অনেক উন্নত , শক্তিশালী ও দ্রুত।
১০।সভ্যতার উপাদানসমূহের গুণগত মানের উন্নতি সাধন অনেকের পক্ষে সম্ভব। বিশিষ্ট কোন বিজ্ঞানীর আবিষ্কৃত সভ্যতার উপাদান কম মেধাসম্পন্ন ব্যাক্তির দ্বারা উন্নত হতে পারে। যেমনঃ বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানীদের দ্বারা রেডিও, টেলিভিশন আবিষ্কার হয়েছে।পরবর্তীতে প্রযুক্তিবিদ দ্বারা এইসব উপাদানের উন্নতি সাধন হয়েছে।
সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এ কথা খাটে না। যেমনঃ সাহিত্য, শিল্পকলা, দর্শন, সংগীত ইত্যাদি কেবল যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যাক্তিরাই উন্নতি সাধন করতে পারে।
১১।সংস্কৃতি মানুষের সুকুমার বৃত্তির বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করে।সভ্যতার সূত্রে মানুষ যে ক্ষমতা অর্জন করে তা কল্যাণকর বা অকল্যাণকর দুই-ই হতে পারে। যেমনঃ বিজ্ঞানকে আমরা আশীর্বাদ ও অভিশাপ দুই-ই বলে থাকি। উল্লেখ্য যে, সভ্যতার একটি উপাদান হচ্ছে বিজ্ঞান।
১২।মানুষের মানসিক প্রশান্তির পরম উৎস হল সংস্কৃতি। অপরদিকে সভ্যতা মানুষের জীবনযাত্রার স্বাচ্ছন্দ্য সৃষ্টিতে সহায়তা করে মাত্র।
সবশেষে বলা যায় যে, সংস্কৃতি ও সভ্যতার মধ্যে পার্থক্য থাকলেও কোনটিই এককভাবে অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারে না।
সংস্কৃতি ও সভ্যতার মধ্যে সম্পর্কঃ
প্রথম মতবাদঃ অনেক সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, সংস্কৃতি ও সভ্যতা এক। মানবসৃষ্টির সব কিছুই সংস্কৃতি হলে, সভ্যতা অর্থ জটিল অগ্রসর সংস্কৃতি ছাড়া কিছুই নয়।তাইলে অনায়াসে বলা যায় যে, সভ্যতা ও সংস্কৃতির মধ্যকার সম্পর্ক অনেকটাই এক।
দ্বিতীয় মতবাদঃ একদল সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, বস্তুগত সংস্কৃতিই সভ্যতা। এই সূত্র ধরে বলা যায় যে, সংস্কৃতি ও সভ্যতার মধ্যকার সম্পর্ক রয়েছে। যেহেতু অবস্তুগত সংস্কৃতি বাদ দিয়ে বস্তুগত সংস্কৃতিই সভ্যতা।