সময়ানুবর্তিতা/সময়ের মূল্য নিয়ে রচনা লিখন

সময়ানুবর্তিতা/সময়ের মূল্য নিয়ে রচনা লিখন

সময়ানুবর্তিতা/সময়ের মূল্য

প্রারম্ভিকাঃ

বিন্দু বিন্দু জল নিয়ে গড়ে উঠে বিশাল জলধি, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুকণা নিয়ে সৃষ্টি হয় মরুভূমি।আর অসংখ্য মুহূর্তের সমন্বয়ে রচিত হয় মানুষের পার্থিব জীবন।সময় অমূল্য সম্পদ।চিরপ্রবাহমানতা তার ধর্ম।চঞ্চল, চপল, স্রোতস্বিনীর মতো সর্বদা আপন গতিতে ধেয়ে চলে; কখনো পেছনে ফিরে তাকায় না।মানবজীবনও সময়ের সেই অনন্ত ছন্দে সুর বেধেছে।সময়ের অন্তহীন প্রবাহে সে ছুটে চলেছে জন্ম থেকে মৃত্যুর অভিমুখে।সময় নিরবধি, কিন্তু মানবজীবন সংক্ষিপ্ত।তাই তো মানুষের চিরন্তন বাণীহারা কান্না-

হায় রে হৃদয়

তোমার সঞ্চয়

দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়

নাই নাই, নাই যে সময়।

-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

সময়ানুবর্তিতা কিঃ

সময়ানুবর্তিতা বলতে সময়ের কাজ সময়ে করাকে বুঝায়।কর্ম সম্পাদনের জন্য সময়কে সঠিকভাবে কাজে লাগানো উচিত।সৃষ্টির প্রথম থেকে আজ পর্যন্ত সময়ের ধারা ক্রমাগত চলছে।সময়ের এই চলমান ধারায় স্বল্পায়ু মানষের জীবন একটা বিন্দুর মতো।প্রাপ্ত সময়টুকু কম বৈচিত্র্যে মুখর করে তোলার জন্য সুযোগ পাওয়া যায় না।তবে যেটুকু পাওয়া যায়,তার মধ্যে নির্ধারিত সময়ে বিশেষ কাজটি সম্পাদন করাতে সময়ের মূল্যবোধের প্রকাশ ঘটে।

সময়ের গুরুত্বঃ

সময়ের এই অস্থির ধাবমানতার জন্যই জীবন মানুষের কাছে পরম মূল্যবান।সময় অনন্ত, কিন্তু জীবন সীমাবদ্ধ।তার এক প্রান্তে জন্ম, এক প্রান্তে মৃত্যু।এই জন্ম- মৃত্যুর শাসনে জীবন সংকুচিত।সময় অনন্ত, কিন্তু জীবন তার অতি সামান্য ভগ্নাংশ মাত্র।জীবন থেকে যে সময় একবার চলে যায় তা আর ফিরে পাওয়া যায় না।সময়ানুবর্তিতার গুরুত্ব সম্পর্কে যথেষ্ঠ সচেতন থাকা উচিত।সময় জীবনকে গঠনের যে সুযোগ দেয়, তাকে কাজে লাগালেই সাফল্য অনিবার্য হয়ে উঠে।বাংলার লোক- কবির কণ্ঠে সময় নিয়ে হাহাকার উচ্চারিত হয়েছে-

এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা,

মধ্যখানে চর।

অর্থাৎ,এপারে জন্ম ওপারে মৃত্যু মাঝখানে সীমাবদ্ধ জীবন।জীবনের এই সীমাবদ্ধতার জন্যই সময় এত বেশি মূল্যবান।

সময়ের মূল্যবোধের অর্থঃ

সময়ের মূল্যবোধ হলো, যে সময়ের যে কাজ, তা সেই সময়ে সম্পাদন করা।যে তা করে না, সে সময়ের অমর্যাদা করে এবং পরাজয়ই হয় তার জীবনের চরম পরিণতি।সময়ের এই অবহেলার জন্য ভবিষ্যতে তাকে অনুশোচনা করতে হবে।যে কৃষক ফসলের ঋতুতে ফসলের বীজ বপন না করে আলস্যে সময় অতিবাহিত করে, সে কিভাবে ফসল ওঠার সময় খামার পূর্ণ ফসল আশা করতে পারে? সময় চলে গেলে তখন কান্নাকাটি করেও লাভ হয় না।প্রবাদে আছে-

সময়ে না দেয় চাষ

তার দুঃখ বার মাস।

মানবজীবনেও সেই একই কথা।জীবনে যখন শক্তি থাকে, সামর্থ্য থাকে, তখন আলস্যে অযথা কালহরন করে জীবন কাটালে শেষ বয়সে অবশ্যই দুঃখ ভোগ করতে হয়।তাই সময়ের মূল্যবোধের গুরুত্ব অনেক।

সময়ের অপচয়ের অর্থঃ

সময়ের মূল্যবোধের অভাবের পেছনে আছে মানুষের নিরাসক্ত জীবনবোধ, আলস্য, উদাসীনতা এবং অদৃশ্য সময়ের নিঃশব্দ অনন্ত যাত্রা।মানুষ মনে করে, সময়ও বুঝি আলস্যের অনড় পাথরের মতো স্থির হয়ে আছে।তাই সময় পৃথিবীর অলস, কর্মবিমুখ মানুষদের ফাঁকি দিয়ে তার অনাদি যাত্রাপথে প্রস্থান করে।কিন্তু সময় পৃথিবীর সেই অলসদের ক্ষমা করে না, সে তাদের অভিশাপ দিয়ে যায়।অন্যদিকে যারা জীবনের সঙ্গে বা সময়ের সঙ্গে প্রবঞ্চনা করে না, সময়ও তাদের সঙ্গে প্রবঞ্চনা না করে তাদের জন্য আশীর্বাদ বর্ষণ করে যায়।প্রকৃত অর্থে বাঁচতে জানে তারাই।জীবন এবং সময় অমূল্য।সময়ের অপব্যবহারের অর্থ যেমন অপচয়, দুর্লভ মানবজন্মও তেমনি অপচয়ের জন্য নয়।

সময়ের চিরন্তন ধর্মঃ

Time and Tide wait for none- সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না।নিরন্তর বয়ে চলাই সময়ের চিরন্তন ধর্ম।কবির ভাষায়-

সময় চলিয়া যায়

নদীর স্রোতের প্রায়।

বাস্তবিকই নদীর স্রোতের মতো সময়ও সর্বদাই অস্থির।মুহুর্তের জন্যও সে স্থির থাকে না।কারো জন্য সে অপেক্ষা করে না।পার্থিব জগতের সমস্ত কিছুকে অনায়াসে অবহেলা করে সময় বাধা- বন্ধনহীন রুপে ছুটে চলে।তার কোনোকিছুর প্রতি অহেতুক আকর্ষণ নেই।আজকের এই রমণীয় সন্ধ্যাটি তার বর্ণচ্ছটা নিয়ে অন্তর্হিত হলে কোটি কোটি যুগের প্রার্থনাতেও তা আর ফিরে আসবে না।প্রতিটি মুহুর্ত আপনার সমগ্র সম্ভাবনা নিয়ে উপস্থিত হয়।আমাদের আহ্বান করে তার ঐশ্বর্য গ্রহণ করে আমাদের স্বল্পস্থায়ী জীবনকে সার্থকতার গৌরবে অবিনশ্বর করে তুলতে।

সময় ও মানবজীবনঃ

সময় অনন্ত, কিন্তু জীবন সীমাবদ্ধ।যে ব্যক্তি সময়মত কাজ করে না, পরাজয়ই হয় তার ভাগ্যলিপি।সময়ের প্রতি অবহেলার জন্য তাকে একদিন অশ্রুমোচন করতে হবে।পলায়নপর সময়ের দিকে তাকিয়ে বিষাদময় কণ্ঠে মনীষী সুইনবার্ন বলেছেন-

His life is a vision or a watch between a sleep and a sleep.

জীবন আসলে শুধু ঘন্টা আর মিনিটের সমষ্টিমাত্র।তাই মানবজীবনে সময়ের মূল্য দেওয়া একান্ত আবশ্যক।মানুষ চায় তার তার সংক্ষিপ্ত জীবনায়তনের মধ্যে বৃহত্তর কর্মের উৎযাপন।কিন্তু সময় তা মঞ্জুর না করে চলে যায়।যে ব্যক্তি সময়ের যথাযোগ্য মর্যাদা দেয়, সময়ের সদ্ব্যবহার করে; সময়ও তাকে একদিন প্রতিষ্ঠার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করে।প্রকৃতপক্ষে সময়ের যথার্থ মূল্যবোধই জীবনে সাফল্য অর্জনের সোপান।

আদি যুগে সময়ের মূল্যঃ

প্রাগৌতিহাসিক যুগের অরণ্যচারী গুহাবাসী আদিম মানুষের জীবনে সময়ের কোনো মূল্যবোধ ছিল না।সমাজ ও সভ্যতার ভিত রচিত হবার পর থেকেই মানুষের জীবনে সময় মূল্যবান সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে।এবং নশ্বর মানুষ অবিনশ্বর হতে সচেষ্ট হয়।এরপর থেকে মানুষ প্রাণান্ত প্রচেষ্টায় জীবনের প্রতিটি মুহুর্তকে কাজে লাগানোর সাধনায় উঠে- পড়ে লাগে।তারই অবশ্যম্ভাবী ফলশ্রুতি হিসেবে মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতির দ্রুত উন্নতি ও বিকাশ সাধিত হতে থাকে।

আধুনিক যুগে সময়ের মূল্যঃ

সময়ের দাবি মিটিয়েই আধুনিক যুগ আজ সভ্যতার বেদিমূলে উপনীত হয়েছে।যারা সময়ের মূল্য প্রদান করে না, তারা গতিহীন, স্থবির ও মৃতপ্রায়।তাদের জীবনে কোনো সম্ভাবনা কখনো হাতছানি দেয় না।বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কারের ফলে সময়ের বর্তমান মূল্য আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।আবিষ্কৃত হয়েছে শব্দের গতির চেয়েও গতিসম্পন্ন কনকর্ড বিমান।মানুষ আজ কয়েক ঘন্টায় পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে পাড়ি জমাচ্ছে।বিশ্ব আজ মানুষের হাতের মুঠোয়।জীবনের সর্বত্রই এসেছে গতি।তাই তো কবি আল্লামা ইকবালের কণ্ঠে আমরা শুনি-

দুর্বার তরঙ্গ এক বয়ে গেল তীব্রবেগে

বলে গেলঃ আমি আছি যে মুহূর্তে আমি গতিমান,

যখনই হারাই গতি সে মুহূর্তে আমি আর নাই।

বাংলাদেশে সময়ের মূল্যবোধঃ

বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষই অশিক্ষিত।তাদের কাছে সময়জ্ঞান স্পষ্ট নয়।তাই এ দেশে সময়ের মূল্যবোধ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি হয় না।ফলে জাতীয় জীবনে এখনো গতি সঞ্চারিত হয় নি।তা না হওয়ায় শিক্ষা জীবনসহ জাতীয়জীবন পঙ্গু হয়ে পড়েছে।জনগণকে শিক্ষিত করে তুলতে পারলেই আমাদের দেশে সময়ের মূল্যবোধ জাগ্রত হবে।

ছাত্রজীবনে সময়ানুবর্তিতাঃ

ছাত্রজীবনই জীবনকে গড়ে তোলার প্রকৃষ্ট সময়।এটাই মানুষের চরিত্র গঠন এবং ব্যক্তিত্ব গঠনের শ্রেষ্ঠ সময়।তাই প্রত্যেক ছাত্রেরই সময়ের সদ্ব্যবহার করা উচিত।পড়ার সময় পড়া, খেলার সময় খেলা- এটিই হওয়া উচিত সময়ের সদ্ব্যবহারের মূলমন্ত্র।আর তিল তিল করে সময়ের সদ্ব্যবহার করলে সাফল্য অবধারিত।অন্যদিকে যে ছাত্র সময়ের সঠিক মূল্যায়ন না করতে পারে, তাকে আজীবন সকলের পেছনে পড়ে থাকতে হয়।তাকে দিয়ে পরিবার, দেশ বা জাতির কোন উপকার হয় না।ছাত্রজীবনে সময়ের সদ্ব্যবহারের প্রতি বিশেষ মনোযোগী না হলে সারাটা জীবন দুঃখ- কষ্টের বোঝা বইতে হয়।তাই তো কবি বলেছেন-

খেলায় মজিয়া শিশু কাটাইও না বেলা,

সময়ের প্রতি কভু করিও না হেলা।

সময়ানুবর্তিতার প্রয়োজনীয়তাঃ

যে জীবন সফলতার জন্যে উন্মুখ সে জীবনে সময়ানুবর্তিতার প্রয়ােজন সর্বাধিক। যার জীবনে সময়ানুবর্তিতা নেই তার জীবনে সফলতার আশা করা বৃথা।অনন্ত কালপ্রবাহে মানুষ বেঁচে থাকে তার সুকীর্তির মধ্য দিয়েই।সুকীর্তি নির্মাণ তার পক্ষেই কেবল সম্ভব যার পক্ষে সময়ানুবর্তী হওয়া সম্ভব।মানুষ পৃথিবীকে সভ্যতার উচ্চশিখরে আজ আসীন করতে পেরেছে সময়ানুবর্তিতা চর্চার মাধ্যমেই।কবি বলেছেন–

নদী আর কালগতি উভয়ে সমান

অস্থির প্রবাহে করে উভয়ে প্রয়াণ।

তাই সময়ের এ প্রবহমান ধারা থেকে সময়কে সঠিকভাবে কাজে লাগানাের মধ্যে জীবনের সাফল্য নির্ভর করে। সময়ানুবর্তিতার মধ্যে মানবজীবনের কৃতিত্ব নিহিত। ঘাসের ডগায় চিকচিক করা শিশিরের মতাে মানবজীবন- যে জীবন প্রভাতেই মিলিয়ে যায় সূর্যের প্রথম সাক্ষাতে।তাই ক্ষণস্থায়ী এ জীবনকে একটি চিরস্থায়ী সম্মানিত আসনে রেখে যেতে হলে প্রয়ােজন সময়ের অনুবর্তী হওয়া।

সময়ের সদ্ব্যবহারঃ

পবিত্র হাদিস শরিফে আছে-

অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা।

অলস ব্যক্তির সমস্ত সময় মন্দ কাজে ব্যয়িত হয়।এতে তার নিজের অসামান্য ক্ষতিও সাধিত হয়।অথচ সময়ের সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে স্বল্পপ্রাণ মানুষ জীবনে অনেক মহৎ কাজ করে স্মরণীয়- বরণীয় হতে পারে।কবির কণ্ঠে তাই ধ্বনিত হয়-

সময়ের মূল্য বুঝে করে যারা কাজ,

তারা হয় স্মরণীয় জগতের মাঝ।

তাই আমাদের প্রত্যেকের উচিত সময়কে সঠিকভাবে ব্যবহার করে জীবনের উন্নতির পথের সন্ধান করা।ব্যক্তিজীবনের মতো জাতীয় জীবনেও সময়ের সদ্ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।যে জাতির সময়জ্ঞান নেই, সে জাতি কখনো উন্নতি লাভ করতে পারে না।সময়ের সদ্বব্যবহার সম্পর্কে ডাঃ মোহাম্মদ লুৎফর রহমান বলেছেন-

সময়ের সদ্ব্যবহার কর,

সময়ের আরেক নাম অর্থ।

উপসংহারঃ

মানুষের জীবন দ্বিতীয়বার পৃথিবীতে আসবে না।তাই মানুষের উচিত এ জীবনকে পরিপূর্ণ করে গড়ে তােলা।এজন্য সময়ানুবর্তিতা একান্ত প্রয়ােজন।সময়ানুবর্তী জীবন উজ্জ্বল জীবনের উপমা।মানুষের সবথেকে বড় অপরাধ হচ্ছে সময়ের অপচয় করা।যারা সময়কে অবহেলা করে তারা জীবনে উন্নতি করতে পারে না। সময় যেহেতু জীবনের সব সাফল্য এবং সুখের মূল তাই আমাদের উচিত সময়ের সদ্ব্যবহারের ক্ষেত্রে সজাগ দৃষ্টি স্থাপন করা। আমাদের সকলকে একটি কথা মনে রাখা উচিত।

পরিশ্রম ধন আনে,

কর্মে আনে সুখ,

আলস্যে দরিদ্র আনে,

পাপে আনে দুঃখ।



আজ এই পর্যন্ত ছিল সময়ানুবর্তিতা বা সময়ের মূল্য নিয়ে রচনা লিখন। পরবর্তীতে আরো রচনা পেতে চোখ রাখুন আমাদের ওয়েবসাইট জুড়ে।

Read More:

 মাদকাসক্তি ও এর প্রতিকার নিয়ে রচনা লিখন

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস নিয়ে রচনা 

বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প নিয়ে রচনা লিখন

নিয়মানুবর্তিতা/শৃঙ্খলাবোধ নিয়ে রচনা