মেঘে ঢাকা তারা; এক বিদ্রোহী সত্ত্বা

মেঘে ঢাকা তারা; এক বিদ্রোহী সত্ত্বা-The Cloud-Capped Star

 

মেঘে ঢাকা তারা;এক বিদ্রোহী সত্ত্বা

সেকালে মাইনষে গঙ্গা যাত্রীর গলায় ঝুলাইয়া দিতো মাইয়া, তারা ছিল “বর্বর”।আর একালে আমরা শিক্ষিত, সিভিলাইজড।তাই লিখাপড়া শিখাইয়া মাইয়ারে নিংড়াইয়া, ডইল্যা, পিষ্যা, মুইছা ফেলি তার ভবিষ্যৎ।ডিফারেন্সটা এই।

 

নিতার বাবা বিজন মাস্টারের এই উক্তিই যেন মেঘে ঢাকা তারা চলচ্চিত্রের মূল উপজীব্য জিনিসটা অনেকখানি স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।

ঋত্বিক ঘটক; চলচ্চিত্র জগতের একজন ভিন্নধর্মী ব্যক্তিত্ব।স্বাভাবিক চলচ্চিত্রের জগতকে যিনি অন্যমাত্রা দান করেছেন।সমাজের ঘটে যাওয়া নিষ্পেষিত ঘটনাগুলোকে তিনি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে আমাদের দেখাতে চেয়েছেন।খুব কম চলচ্চিত্রই ওনি নির্মাণ করেছেন।যার মধ্যে ১৯৬০ সালে মুক্তি পাওয়া শক্তিপদ রাজগুরুর কাহিনী অবলম্বনে মেঘে ঢাকা তারা অন্যতম।তার আটটি চলচ্চিত্রের মধ্যে মেঘে ঢাকা তারা সবেচেয়ে বেশি পরিচিত ও আলোচিত।

পঞ্চাশের দশকে দেশবিভাগের পর কলকাতা শহরের এক মধ্যবিত্ত পরিবারকে ঘিরেই এই গল্পটি আবর্তিত।

নীতা; পরিবারের বড় মেয়ে।নীতাই মূলত চলচ্চিত্রের মূল চরিত্র।বাবা মাস্টারমশাই, স্কুলে বাচ্চাদের লেখাপড়া করায় এবং মা গৃহিনী।তাছাড়া আরো দুই ভাই, আর এক বোন আছে নীতার।

বড় ভাই শংকর, একজন শিল্পী।সারাদিন একজন বড় গায়ক হবার স্বপ্নে সে বিভোর থাকে।সংসারে কি হচ্ছে, কে কি করছে এসব নিয়ে সে বড্ড অসচেতন।

আর বাকি দুই ভাই- বোন গীতা আর মন্টু, প্রচন্ড আত্মকেন্দ্রিক।নিজেদের স্বার্থ ব্যতীত অন্য কোনোদিকেই তাদের মন নেই।

পুরো সংসারের একমাত্র অবলম্বন নীতা।সবার আশা মিটাতে ব্যস্ত হয়ে নিজের স্বাদ- আহ্লাদটুকুও মাটিতে মিশিয়ে ফেলে সে।নিজে টিউশনি করে, ছেঁড়া চটি পরে নিজের ইচ্ছার কথা ভুলে সে সবার পাশে থাকে।এমনকি নিজের ভালবাসার মানুষ সনৎ; যাকে সে নিজের থেকেও বেশি ভালবাসে।পি.এইচ.ডি ফেরত সনৎ চাকরী না করে গবেষণায় ব্যস্ত থাকে।সে স্বপ্ন দেখে স্কলারশিপ পাওয়ার।তাকেও বেকার অবস্থায় নীতা আর্থিকভাবে সাহায্য করে।বড় ভাই শংকর, কোনো কাজ করে না।তবু নীতা তাকে সবসময় আগ্রহ জোগাতে থাকে।নিজের হাতখরচের টাকাটাও ভাইকে দিয়ে দেয়।তাকে সবসময় বলে,

দাদা! তুই একদিন বিরাট হবি! সেদিন আমার আর কোনো দুঃখ থাকবে না।

আকস্মিক এক দুর্ঘটনায় একসময় নীতার বাবা শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন।তখন সম্পূর্ণ পরিবারের দায়িত্ব নীতার ঘাড়ে এসে পড়ে।পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে মাত্র বি.এ পাশ করে পরিবারের সবার আশা টিকিয়ে রাখতে প্রাণপণ সংগ্রামে নেমে পড়ে নীতা।চাকরি করতে শুরু করে সে।এমতাবস্থায় সনৎও তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসে।কিন্তু নীতা রাজি হতে পারে না।রাজি হলে যে তার পুরো পরিবার পথে বসবে।পরিবারের কথা ভেবে সনৎকে বিয়ের জন্য অপেক্ষা করতে বলে সে।

কিন্তু এত কষ্ট, ত্যাগ সব করেও দিনশেষে ধোঁকা ছাড়া আর কিছুই পাইনি নীতা।সনতের সাথে তার নিজেরই আপন বোন গীতা সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে।প্রেমিক সনৎও নীতাকে দুরে ঠেলে দিয়ে বহুদিনের আকর্ষণ চঞ্চল গীতাকে বিয়ে করে।পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজের নির্মমতা দেখে গীতা নির্বাক হয়ে যায়, তবু মুখ ফুটে সে কিছু বলে না।তখনও নিজেকে উজাড় করে দিয়ে সে বাঁচিয়ে রাখতে চায় অন্যের স্বপ্নগুলো।

বড় ভাই শংকর সব বুঝতে পারে।বোনকে ধোঁকা দিয়ে বোনের প্রেমিকের সাথে বিয়ে করে সুখের সংসার সাজানোটা শংকর মেনে নিতে পারে না।তাই বিয়ের রাতেই সে বাড়িছাড়া হয়।চলে যায় পরিবারের সব মায়া- বন্ধন ত্যাগ করে।

এদিকে ছোট ভাই মন্টু দুর্ঘটনায় আহত হলে সেখানেও নীতা এগিয়ে যায়।ভাইয়ের রক্তের টাকা জোগাড় করতে সবখানে মরিয়া হয়ে খুজে সে।এমনকি প্রাক্তন প্রেমিক সনতের কাছে যেতেও তার দ্বিধা হয় না।নীতার এত উদারতা, সব ভুলে বেঁচে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা; সব কেমন যেন বিস্ময়কর অবিশ্বাসের মত লাগে!

ধীরে ধীরে নীতার শরীর ভেঙে পড়তে থাকে।মানসিকভাবে তো সে অনেক আগেই ভাঙা ছিল, এখন শারীরিকভাবেও সে ভেঙে পড়তে শুরু করে।এমনকি যক্ষ্ণায় আক্রান্ত হয়েও কাউকে কিচ্ছুটি বলে না নীতা, সব মুখ বুঝেসহ্য করতে থাকে।যেন এতদিনে সে একটা মৃতপ্রায় নির্বাক পাথর হয়ে গেছে।নীতা অসুস্থ হয়, যক্ষ্ণা হয়, শরীর ভেঙে পড়ে তবু হাল ছাড়ে না পরিবারের।উল্টো আরো বেঁচে থাকার লড়াই করতে থাকে সে।

একসময় বড় ভাই শংকর বাড়ি ফিরে আসে।ততদিনে সে বিখ্যাত গায়ক হয়ে গিয়েছে।গ্রামের যারা আগে তাকে দেখলে তিরষ্কার করত; তারাই এখন তাকে দেখলে সম্মান করে, অটোগ্রাফ চাই।বাড়ি ফিরে সে দেখে নীতার যক্ষ্ণা হয়েছে, কিন্তু বাসার কারো সেদিকে ভ্রক্ষেপটুকুও নেই।কিন্তু বড় ভাই সেটা মানতে পারেনা।অসুস্থ বোনকে শংকর শিলং পাহাড়ের এক হাসপাতালে ভর্তি করে।যাতে তার ছোট বোন পাহাড় দেখে দেখে চিকিৎসা করতে পারে।

শেষ দৃশ্যে জীবন- মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে নীতা তার দাদাকে বেঁচে থাকার প্রাণপণ আকুতি জানাতে থাকে।ভেঙে যাওয়া হৃদয় নিয়ে সে আবার বেঁচে থাকার ইচ্ছা জানায়।নীতার বেঁচে থাকার তীব্র আকুতি আকাশে বাতাসে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে।সে গগনবিদারী হাহাকার নিয়ে বলতে থাকে-

দাদা আমি কিন্তু বাঁচতে চেয়েছিলাম! দাদা, তুমি একবার বলো যে আমি বাঁচবো! আমি যে সত্যিই বাঁচতে চেয়েছিলাম।দাদা, আমি বাঁচবো! দাদা, আমি বাঁচবো!

পরিশেষে,

দারিদ্র্যের নির্মম কশাঘাত, নারী শোষণ, মধ্যবিত্তের জীবনের কঠিন টানাপোড়ন, পুরুষতান্ত্রিকতা; এ যেন আমাদের দেখা নিত্যকার বাস্তব ঘটনার মতো।চলচ্চিত্রের নীতার মতোই হাজারো নীতা আমাদের চারপাশে রয়েছে, যারা অন্যের ভালবাসা মিটাতেই ব্যস্ত।

মেঘে ঢাকা তারা চলচ্চিত্রে সনৎ একদিন নীতাকে বলেছিল সে হচ্ছে মেঘে ঢাকা তারার মতন।যার মধ্যে আছে লুকায়িত ঔজ্জ্বল্য।কিন্তু সংসারের নিষ্ঠুর টানাপোড়নে যে এই ঔজ্জ্বল্য ক্ষয়ে গেছে, সেটা কেউ বুঝতে পারেনি।নীতা তো সেটা বুঝতেই দেয়নি।

নীতার পাহাড়ের উপরের সেই আকুতি এখনও এই সমাজে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।আমাদের সমাজের নারীরা তো সেই শেকলবিহীন খাঁচায় বন্দি হয়েই রয়েছে।

এই চলচ্চিত্রের কোনো শেষ নেই।অসমাপ্ত সমাপ্তিই এই চলচ্চিত্রের শেষ।নীতার মত মেঘে ঢাকা তারাদের কোনো মৃত্যু নেই, সমাপ্তি নেই।তারা বাস্তবে কখনো মরে যায় না।কারণ তাদের মত তারাদের আলোতেই তো বৃদ্ধ পিতা, অভাবের তাড়নায় রুঢ় মা, আত্মকেন্দ্রিক ভাই- বোন, উদাসীন দাদা এমনকি নীতিহীন প্রেমিকেরা আলোকিত হয়ে এসেছে যুগযুগ ধরে।

ঋত্বিক ঘটকের সৃষ্ট এই বৃত্তে নীতাদের কোনো মৃত্যু নেই।চলচ্চিত্রের শুরুতে যেমন নীতার চটিজোড়া ছিঁড়ে গেলে সে চটিজোড়া হাতে নিয়ে বাড়ি ফেরে।চলচ্চিত্রের শেষ দৃশ্যেও তেমনি আরেকটি মেয়ের চটিজোড়া ছিঁড়ে যায়।এই ছেঁড়া বৃত্তের মাধ্যমেই পরিচালক আমাদের দেখাতে চেয়েছেন, নীতারা কখনো মরে না।তারা যুগ যুগ ধরে আমাদের মাঝেই বেঁচে থাকে।


Read More:

চারুলতা ,সত্যজিৎ রায় মুভি
উদারিং হাইটস 2011;মনস্তাত্বিক দ্বান্ধিকতার অভূতপুর্ব আখ্যান
ডিপারচারস-জীবন ও মৃত্যুর অপার্থিব সম্পর্ক
এ বিউটিফুল মাইন্ড; ভালবাসার রহস্যময় সমীকরণ