শ্রমের মর্যাদা নিয়ে রচনা লিখন

শ্রমের মর্যাদা নিয়ে রচনা লিখন

শ্রমের মর্যাদা 

ভূমিকা:

A hard working street-cleaner is a better man than a lazy scholar.

-আইনস্টাইন। 

অণু হতে অট্টালিকা পর্যন্ত, বিশ্বসভ্যতার প্রতিটি সৃষ্টির মূলে রয়েছে শ্রম।শ্রমকে ভিত্তি করেই সমাজ-সংস্কৃতির বৃদ্ধি এবং প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছে।মানুষ তার শ্রম উৎসর্গ করে পৃথিবীকে দিয়েছে সভ্যতার সোনালী মূর্তি।অথচ এদের নাম ইতিহাসের পাতায় স্থান পায়নি।কালের পরিক্রমায় বিবর্তনের নানা স্তর পেরিয়ে আধুনিক বিশ্বসভ্যতার যে রুপে আমরা জীবন জীবিকা নির্বাহ করছি, তা মূলত তাদের পরিশ্রমেরই ফসল।


শ্রমের শ্রেণিবিভাগ:

এই জগৎ-সংসারের সমস্ত কাজ একই ধরনের হয়ে থাকে না।তাছাড়া সবাই সকল কাজ সম্পন্ন করতে পারে না।কারো শ্রম হয় শারীরিক কসরতের মাধ্যমে।আবার কারো শ্রম হয় সম্পূর্ণ মানসিক, যেথায় শরীরের কসরতের কোনো প্রয়োজন ঘটে না।এদিক দিয়ে শ্রমকে দুভাগে ভাগ করা যায়।যথা:

১।কায়িক বা শারীরিক শ্রম।

২।মানসিক শ্রম।


মানসিক শ্রম:

মানসিক শ্রম ব্যতীত মানসিক উন্নতি সম্ভব নয়।কথায় আছে-

অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা।

বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক, সাহিত্যিক, চিকিৎসক, রাজনীতিবিদ, সমাজতত্ত্ববিদ এদের শ্রম মূলত ভাবভিত্তিক বা মানসিক।তাদের নতুন নতুন ভাবনাকে বাস্তবে রুপ দিতে সহায়তা করে কায়িক শ্রমিকরা।


কায়িক বা শারীরিক শ্রম:

কায়িক এবং মানসিক শ্রম উভয়েই একে অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।মানসিক শ্রম একটি কাজের অনুপ্রেরণা যোগায়।অন্যদিকে, কায়িক শ্রমের মাধ্যমে তা বাস্তবায়িত হয়।বেশিরভাগ শ্রমজীবি মানুষেরা কায়িক শ্রম করে থাকে।কৃষক, শ্রমিক, জেলে, কুলি এরা মূলত কায়িক শ্রমিক।


শ্রম ও উপার্জন:

মানুষ পরিশ্রম করেই নিজের ভাগ্যের পরিবর্তন করতে পারে।পরিশ্রমী মানুষ সর্বদা সফল হয়।আমাদের জীবনধারণের জন্য শ্রমের কোনো বিকল্প নেই।আদিম গুহাবাসী মানুষ হতে আজকের এই সভ্য সমাজ সৃষ্টির পেছনে পরিশ্রমের অবদান অনস্বীকার্য।তাই তো বলা যায়-


তাঁতি বসে তাঁত বোনে, জেলে বোনে জাল,

বহুদুর প্রসারিত এদের বিচিত্র কর্মভার,

তারি পরে ভর দিয়ে চলিতেছে সমস্ত সংসার।


মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশে শ্রম:

সভ্যতার প্রতিটি স্তরেই রয়েছে শ্রমের অসামান্য অবদান।সভ্যতার শুরুতে ছিল বৈরী-প্রতিকূল পরিবেশ।এই পরিবেশ ও প্রকৃতি মানুষের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলেছিল।তখন থেকেই মানুষ পরিশ্রমকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চেষ্টা শুরু করেছে।গ্রিক ও রোমান সভ্যতা গড়ে উঠেছে বুদ্ধিজীবীদের মানসিক শ্রম এবং ক্রীতদাসদের কায়িক শ্রমের ফলে।একবিংশ শতাব্দীর এই উন্নত বিশ্বের পেছনেও কিন্তু শ্রমের অবদান অনস্বীকার্য।কবির ভাষায়-


গাহি তাহাদের গান....

শ্রম-কিণাঙ্ক-কঠিন যাদের নির্দয় মুঠি-তলে,

ত্রস্তা ধরণী নজরানা দেয় ডালি ভরে ফুলে ফলে!


শ্রমের প্রয়োজনীয়তা:

পৃথিবী নামক এই সংসারে শ্রমের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।মানুষ একদিকে যেমন সভ্যতার স্রষ্টা, অপরদিকে নিজের ভাগ্য নির্মাতা।শ্রমই মানুষের কাছে সৌভাগ্য রচনা ও প্রতিভা বিকাশের মহামন্ত্র।বর্তমান পৃথিবীর মানুষও উন্নত বিশ্ব সৃষ্টির লক্ষ্যে শ্রমসাধনাকেই বেছে নিয়েছে।বাংলায় একটি প্রবাদ আছে-

পরিশ্রমে ধন আনে,

পূণ্যে আসে সুখ,

আলস্যে দারিদ্র্য আনে,

পাপে আনে দুখ।


সুস্থতার জন্য শ্রম:

পরিশ্রম মানুষের দেহ ও মনকে সবল করে।প্রতিদিন নির্ধারিত কর্তব্য পালন করতে করতে মনকে সতেজ করতে পরিশ্রমের প্রয়োজন হয়।কর্মঠ লোকদের প্রতিটি স্বপ্নই শুরু হয় নতুন আশা-উদ্দীপনা নিয়ে।আর অলস লোকরা স্বপ্নই দেখতে আগ্রহী হয় না।কথায় আছে-

Man is the architect of his own fate.


সৌভাগ্য ও প্রতিভা বিকাশে শ্রম:

প্রত্যেক মানুষের মধ্যে রয়েছে সুপ্ত প্রতিভা।কেউ কেউ সেই সুপ্ত প্রতিভা জাগ্রত করতে পারে, আর কারো কারো প্রতিভা অলসতার কারণে সুপ্তই থেকে যায়।এছাড়া মানুষের ভাগ্য নির্মাতা মুলত মানুষ নিজেই।পরিশ্রমই সৌভাগ্যের বাহক।বলা যায়-

Man is the architect of his fortune.

শ্রমের মাধ্যমে জাতি অর্জন করে দক্ষ, পরিশ্রমী মানবশক্তি।যার মাধ্যমে একটি দেশের উন্নয়ন সম্ভব।


সুখ-সম্পদ ও শ্রম:

মানুষ প্রতি মুহুর্তে সুখের অন্বেষণে ছুটে বেড়ায়।সুখের আশা করে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।যারা অলস তারা কখনোই সফলতার সর্বোচ্চ শিখরে পৌছাতে পারে না।পরিশ্রমের মাধ্যমে একজন নিতান্ত দরিদ্র মানুষও সম্পদশালী ব্যক্তিতে পরিণত হতে পারে।ইংরেজিতে একটা কথা আছে-

Industry is the mother of goodluck.

অর্থাৎ পরিশ্রমই সৌভাগ্যের প্রসূতি।


শ্রমবিমুখতা:

শ্রমবিমুখতা ও অলসতা জীবনে বয়ে আনে নিদারুণ অভিশাপ।শ্রমহীন জীবনকে ব্যর্থতা এসে অক্টোপাসের মতো ঘিরে ফেলে।যে ব্যক্তি শ্রমকে অবজ্ঞা করে, তার জীবনের কোনো মূল্যই নেই।আমাদের দেশে শ্রমবিমুখ মানুষের অভাব নেই।তারা নিজেরা তো শ্রমবিমুখই, সেই সাথে যারা শ্রমিক তাদেরও মূল্য দেয় না।সামান্য শিক্ষিত লোকেরাও শ্রমকে ঘৃণার চোখে দেখে।যার কারণে উন্নতির দিক দিয়ে আমরা পিছিয়ে আছি।আমাদের উচিত শ্রম নিয়ে সবার ভ্রান্ত ধ্যান-ধারণা দুর করা।যতীন্দ্রমোহন বাগচীর মতো বলতে চাই-

বিশ্বপিতার মহাকারবার এই দিন দুনিয়াটা

মানুষই তাহার মূলধন, কর্ম তাহার খাটা।


ব্যক্তিজীবনে শ্রমের উপযোগিতা:

পরিশ্রমী মানুষদের দেহ ও মন সুন্দর থাকে।যারা পরিশ্রমী, তারা সবসময় সফল হয়।বিশেষ করে ছাত্রজীবনে পরিশ্রম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।অন্যদিকে, যারা পরিশ্রমী না তাদের জীবনের স্বাভাবিক অগ্রগতি রুদ্ধ হয়।তারা কোনো কাজে সফল হতে পারেনা।তাই ব্যক্তিজীবনে শ্রমের উপযোগিতা অনেক।কবি বলেছেন-

কৃষকের পুত্র কিংবা রাজার কুমার,

সবারই রয়েছে কাজ এ বিশ্ব মাঝার।

 

শ্রমের মর্যাদা:

যারা পরিশ্রম করে জীবনধারণ করে, তাদের সামাজিক মর্যাদাও সমুন্নত।অন্যদিকে, অলস ব্যক্তিরা সমাজে ঘৃণার পাত্র।তারা সবসময় পরনির্ভরশীল হয়ে থাকে।পরিশ্রমী লোক কখনো কোনো কিছুর জন্য অন্যের উপর নির্ভরশীল থাকে না।পৃথিবীতে যত মানুষ গৌরব অর্জন করেছেন, তারা সবাই কঠোর পরিশ্রম করেছেন।এক মনীষী বলেন-

ক্ষণস্থায়ী জীবনটাকে পরিশ্রম দ্বারা যত বেশি পারা যায় কাজে লাগাইয়া লও।


মহামানবদের কাছে শ্রমের মর্যাদা:

বিশ্বের সকল মহামানবগণ শ্রমের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন।আদিমকাল হতে মানুষ পরিশ্রমী।ইসলাম ধর্ম মতে, মানুষের আদি পিতা আদম ও মাতা হাওয়া কোনো দাসদাসী ব্যতিত স্বর্গ হতে পৃথিবীতে এসেছিলেন।তাই বলা হয়-

When Adam delved and Eve span

Who was than a gentle man?


এছাড়াও গৌতম বৌদ্ধের কথা না বললেই নয়।তিনি ১২ বছর কঠোর সাধনার মাধ্যমে সমাজে নিষ্পেষিত মানুষদের মুক্তির পথ খুজেছেন।প্রত্যেক মহামানবই আমাদের পরিশ্রমী হওয়ার শিক্ষা দেয়।


উন্নত বিশ্বে শ্রমের মর্যাদা:

বিশ্বের যে সকল দেশ আজ মাথা উঁচু করে উন্নতির শিখরে দাঁড়িয়ে আছে, তাদের মুলে রয়েছে শ্রমের মর্যাদা।মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব দেশেই শ্রমকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দেওয়া হয়।২য় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপান-জার্মানি ধ্বংসস্তূপ হতে মাথা উঁচু করে দাড়াতে সক্ষম হয়েছে শুধুমাত্র শ্রমের কারণে।এছাড়াও বিভিন্ন দেশে শ্রমকে অত্যন্ত মুল্যবান হিসেবে দেখা হয়।


আমাদের দেশে শ্রমের মর্যাদা:

আমাদের দেশে কায়িক শ্রম কখনো পূর্ণাঙ্গ মর্যাদা লাভ করেনি।শ্রমবিমুখতা আমাদের জাতীয় বৈশিষ্ট্য।যার কারণে শ্রম সম্পর্কে আমাদের দেশে বিরুপ ধারণা বিদ্যমান।"লেখাপড়া শিখে ভদ্রভাবে কলম পিষে বড়লোক হবে" এইরকমই আমাদের দেশের বেশিরভাগ নাগরিকের স্বপ্ন।তারা সকল প্রকার শ্রমকে অবমুল্যায়ন করে।শ্রম সম্পর্কে এইসব ধ্যান-ধারণার পরিবর্তন ঘটাতে হবে।হাদিস শরিফে বলা আছে-

শ্রমিকের ঘাম শুকাইবার পূর্বেই যেন তাহার শ্রমের মূল্য পরিশোধ করা হয়।

তাই,আমাদের দেশকে একটি উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাইলে শ্রমবিমুখতা পরিহার করে শ্রমিকদের পাশে এসে দাড়াতে হবে।


শ্রম সম্পর্কে কবি-সাহিত্যিকদের ধারণা:

পৃথিবীর সকল কবি-সাহিত্যিকেরা শ্রমের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তারা তাদের লেখনীর মাধ্যমে শ্রমিকদের অনুপ্রাণিত করেছেন।শ্রমিকদের শোষণ-বঞ্চনা তুলে ধরেছেন।কবি শেলী শ্রমিকদের সমস্ত উৎপীড়নের বিরুদ্ধে জাগ্রত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন-


Sow seed-but let no tyrant reap,

Find wealth-let no imposter heap,

Weave robs-let not the idle wear,

Forge arms-in your defence to bear.


এছাড়াও আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেন-

হাতুড়ি শাবল গাইতি চালায়ে ভাঙিল যারা পাহাড়,

পাহাড়-কাটা সে পথের দুপাশে পড়িয়া যাদের হাড়,

তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাহাদেরি গান,

তাদেরই ব্যথিত বক্ষে পা ফেলে আসে নব উত্থান।


এভাবেই কালে কালে, দেশে দেশে কবি-সাহিত্যিকেরা তাদের সাহিত্যকর্মে শ্রমকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে তুলে ধরেছেন।


শ্রমের ক্ষেত্রে নানা দৃষ্টিভঙ্গি:

কর্মের প্রত্যাশা রেখে মানুষ পৃথিবীতে এসেছে।তাই পৃথিবীর উন্নয়নের জন্য সকল মানুষের পরিশ্রম করা আবশ্যক।কিন্তু সকল মানুষের পক্ষে সকল কাজ করা সম্ভব নয়, তাতে সামাজিক বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে।তাই মানুষ শ্রমের শ্রেণিবিভাগ করেছে।কিন্তু এর ফলে সৃষ্টি হয়েছে জাতিভেদ প্রথা।বিশেষ করে, ভারতীয় উপমহাদেশে এ ঘৃণিত জাতিভেদ প্রথা মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি করেছে।কিন্তু উন্নত বিশ্বে এরকম দৃষ্টিভঙ্গি নেই।তাই তারা শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি লাভ করেছে।


শ্রমশীল ব্যক্তির উদাহরণ:

জগতে সেইসব ব্যক্তিই স্মরণীয় হয়ে আছেন, যাদের জীবনের মূলমন্ত্রই ছিল পরিশ্রম।মাইকেল মধুসূদন দত্ত, কাজী নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখের কঠোর পরিশ্রমের ফলেই তারা আজ বাঙালীর হৃদয়ে সমাদৃত।এছাড়াও আমেরিকার ষোড়শ প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন পরিশ্রমের মাধ্যমেই গৌরবের উচ্চ শিখরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।এছাড়াও প্রাচীন যুগে ফেরদৌসী অনেক সাধনার পর রচিত করেছিলেন "শাহনামা"। বিশ্বের বুকে প্রথম শ্রমিকরাজ প্রতিষ্ঠার অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন লেনিন।এছাড়াও ইতিহাসের পাতায় শ্রমজীবী এমন অনেক মানুষ রয়েছে যারা নিজ কীর্তির কারণে অমরত্ব লাভ করেছেন।তাই বলা হয়-

নাম মানুষকে বড় করে না,

মানুষই নামকে জাগিয়ে তোলে।


উপসংহার:

শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে হলে সকল সংকীর্ণতা ত্যাগ করতে হবে এবং কোনো শ্রমকেই অবজ্ঞার চোখে দেখা যাবে না।সবার সম্মিলিত শ্রমই একটি জাতি ও দেশকে উন্নত করতে পারে।শ্রমই জাগতিক সুখ ও ঐশ্বর্যের মূলমন্ত্র।কবির ভাষায়-

কেন পান্থ ক্ষান্ত হও,

হেরি দীর্ঘ পথ,

উদ্যম বিহনে কার পুরে মনোরথ?



এই পর্যন্ত ছিল শ্রমের মর্যাদা নিয়ে রচনা লিখন। আরো রচনা পড়তে চাইলে,

 মাদকাসক্তি ও এর প্রতিকার নিয়ে রচনা লিখন

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস নিয়ে রচনা 

বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প নিয়ে রচনা লিখন

নিয়মানুবর্তিতা/শৃঙ্খলাবোধ নিয়ে রচনা 

সময়ানুবর্তিতা/সময়ের মূল্য নিয়ে রচনা লিখন