নিয়মানুবর্তিতা/শৃঙ্খলাবোধ নিয়ে রচনা

নিয়মানুবর্তিতা/শৃঙ্খলাবোধ নিয়ে রচনা

 

নিয়মানুবর্তিতা/শৃঙ্খলাবোধ

প্রারম্ভিকাঃ

যে সমাজে শৃঙ্খলা আছে, ঐক্যের

বিধান আছে, সকলের সতন্ত্র স্থান

ও অধিকার আছে, সেই সমাজেই পরকে

আপন করিয়া লওয়া সহজ।

-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

সমস্ত বিশ্বপ্রকৃতি এক অদৃশ্য নিয়ম- শৃঙ্খলার অধীন।সৌরজগতের গ্রহ উপগ্রহ থেকে পৃথিবীর গাছপালা, সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত ও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কীটপ্রত্যঙ্গ পর্যন্ত একটি নির্দিষ্ট ও কঠোর নিয়ম শৃঙ্খলায় নিয়ন্ত্রিত।কোথাও এর সামান্যতম ব্যতিক্রম বা বিপর্যয় নেই।সম্রাট নেপোলিয়নের ভাষায় বলা যায়, Discipline is the key stone to success which is compulsory to follow to balances the systems. মানবজীবনেও প্রয়োজন সেই কঠিন জীবনের শাসন।মানুষের জীবনকে সুন্দর করে তুলতে হলে তার জীবনেও শৃঙ্খলাবোধ বা নিয়মানুবর্তিতার দরকার।কারণ, শৃঙ্খলাই সৌন্দর্য ও জাতীয় উন্নতির উপায়।

জীবনে নিয়মানুবর্তিতার প্রয়োজনীয়তাঃ

শৈশবকালই মানবজীবনে প্রবেশের সিংহদ্বার।কাজেই শৈশবের শুভলগ্নেই নিয়মানুশীলনের শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়।মানবজমিনে সোনা ফলাতে হলে চাই নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলাবোধের বিশ্বস্ত অনুশীলন।কঠিন নিয়মের বাঁধনে বাঁধতে না পারলে পরিবারে ভাঙন ধরে, সমাজ টেকে না, রাষ্ট্র বিপর্যস্ত হয়, প্রতিষ্ঠান অচল হয়ে পড়ে।সভ্যতা যতই প্রসার লাভ করেছে, মানুষের সামাজিক আচরণবিধি ততই বিশিষ্ট রুপ পেয়েছে।অসভ্য, অর্ধসভ্য এবং সুসভ্য সমাজের চেহারাটি সঠিক চিনে নিতে পারা যায় সে সমাজের নিয়ম- শৃঙ্খলা লক্ষ করে।জনগোষ্ঠীর সুশৃঙ্খল কার্যক্রম তার উন্নত সভ্যতার পরিচয় বহন করে।

নিয়মানুবর্তিতার শ্রেণিবিভাগঃ

জীবনে নিয়মানুবর্তিতাকে প্রধানত দু ভাগে ভাগ করা যায়।দেহ গঠনে নিয়মানুবর্তিতা এবং মনোগঠনে নিয়মানুবর্তিতা।সুস্থ জীবনে দুটিই সকলের কাম্য।এই সুস্থতার জন্য আমাদের আহার, নিদ্রা, দৈহিক শ্রম ইত্যাদি সম্পর্কে সচেতন থাকা উচিত।আমাদের দেহ অভ্যন্তরীণ আন্ত্রিক প্রক্রিয়ার সুনির্দিষ্ট নিয়মে পরিচালিত।তাই আমাদের দেহকে সুস্থ রাখার জন্য কাজকর্ম, আহার ও নিদ্রার মধ্যে শৃঙ্খলা বা নিয়মানুবর্তিতা একান্ত প্রয়োজন।

মনোগঠনের দিক থেকে আমাদের জীবনে নিয়মানুবর্তিতার প্রয়োজনীয়তা কম নয়।মানুষ হিসেবে আমাদের নিজেদের প্রতি শুধু নয়, পরিবারের প্রতি, সমাজের প্রতি এবং রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্ববোধ আছে।এ দায়িত্ব হচ্ছে মানবিক।এই দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য মনের বিকাশ দরকার।

সামাজিক জীবনে নিয়মানুবর্তিতাঃ

প্রতিটি কর্মানুশীলনের আছে একটি বিশেষ ধারাক্রম, যার নাম ছন্দ।সেই ছন্দই শৃঙ্খলা বা নিয়মানুবর্তিতা, সেই ছন্দই সাফল্যের পুরোহিত।শৈশব থেকে মানুষকে সমাজে বিচরন করতে হয়, গ্রহণ করতে হয় নানা সামাজিক দায়িত্ব।কিন্তু সমাজের প্রতিটা মানুষ যদি খেয়াল- খুশিমত যথেচ্ছাচার শুরু করে, তাহলে সমগ্র সমাজটাই উচ্ছৃঙ্খলতার উন্মাদাগারে পরিণত হবে।তাই সামাজিক জীবনে শৃঙ্খলা বিধান অপরিহার্য।

পারিবারিক জীবনে নিয়মানুবর্তিতাঃ

পরিবার সমাজের এক একটি ক্ষুদ্র পঙক্তি।পারিবারিক শৃঙ্খলা বা নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে দিয়ে সামাজিক শৃঙ্খলা আসে।তাই পরিবারের সদস্য হিসেবে প্রতিটি মানুষের উচিত পারিবারিক নীতিকে গুরুত্ব দেওয়া, যা মানুষের জীবনে সামগ্রিকভাবে শৃঙ্খলা এনে দেয়।

ছাত্রজীবনে শৃঙ্খলাঃ

ছাত্রজীবনে শৃঙ্খলা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।বলা যায়, ছাত্রজীবনই নীতিচেতনা- নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলাবোধ অনুশীলনের প্রকৃষ্ট সময়।ছাত্রজীবনই জীবন গঠনের, পরবর্তীকালে যথার্থ মানুষ হয়ে ওঠার প্রকৃত সময়কাল।সৈন্যদলের মতো ছত্রদেরও মেনে চলতে হবে এই নিয়ম ও শৃঙ্খলা।নিয়ম- শৃঙ্খলা গড়ে তোলে সৈন্যবাহিনীকে তাদের জয়ের সম্মুখীন করে; নিয়মনিষ্ঠা এবং শৃঙ্খলাবোধ এভাবেই ছাত্রদেরও জয়ী করে, জীবনে সার্থকতা এনে দেয়।অধ্যয়নকক্ষে পাঠ ও গঠনকক্ষে প্রাত্যহিক জীবনচর্চায় ছাত্রদেরও নিয়ম- শৃঙ্খলা কঠোরভাবে অনুশীলন করতে হবে।সব ছাত্র হয়তো মেধাবী নয়, অর্থ সামর্থ্যও সকলের বেশি থাকে না, কিন্তু ছাত্র যদি নিয়মনিষ্ঠ জীবনযাপন করে, শিক্ষাক্ষেত্রে যদি উপযুক্ত শৃঙ্খলা মেনে চলে, জীবন যাপনেও যদি তার প্রয়োগ ঘটায়; তবে ছাত্র ভবিষ্যতের শ্রেষ্ঠ নাগরিক, শ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমিকরুপে গড়ে ওঠতে পারে।

শৃঙ্খলা ও মানবসমাজের উন্নতিঃ

মানবসভ্যতার বর্তমান চরম বিকাশের মূলেও আছে মানুষের সুশৃঙ্খল ও সুসংহত কর্মোদ্যোগ।যেখানে শৃঙ্খলা নেই, সেখানে শ্রী নেই, কল্যাণ নেই, আনন্দ নেই, শান্তি নেই।সেই নিরানন্দ, কল্যাণ শ্রীহীন, সুষমাহীন অশান্ত অরাজকতায় ঘনিয়ে আসে মানবজীবনের অন্তিমলগ্ন।শৃঙ্খলাবদ্ধ, নিয়মানুবর্তী, সুসংহত সৈন্যবাহিনীই যুদ্ধে বিজয় অর্জন করতে পারে।তাই তো সুশৃঙ্খল জাতির ভাগ্যে জোটে সাফল্যের জয়টিকা এবং উচ্ছৃঙ্খল জাতির ভাগ্যে জোটে পরাজয়ের দুঃসহ গ্লানি।আমাদের অর্থনৈতিক জীবনকেও সুষ্ঠুভাবে চালনার জন্য প্রয়োজন অর্থনৈতিক শৃঙ্খলাবোধ।পরিমিত ব্যয় এবং আয় ও ব্যয়ের মধ্যে সমতা না থাকলে শৃঙ্খলাবোধহীন বেহিসেবী মানুষ জীবনে নানা দুঃখ- দুর্দশার সম্মুখীন হয়।

বর্তমানে ছাত্র উচ্ছৃঙ্খলতার কারণঃ

সম্প্রতি ছাত্রসমাজের উচ্ছৃঙ্খলতায় সকলেই উদ্বিগ্ন।তাদের উচ্ছৃঙ্খলতার কলঙ্কিত স্বাক্ষর পড়ে পরীক্ষাগৃহে, বাসে, রেলে, পথেঘাটে, সমাজজীবনের অলিতে গলিতে।ছাত্রসমাজ অগ্রযাত্রীর দল।তারা স্বভাবতই অগ্রসর হতে চায়, চায় কর্মব্যস্ততা।কিন্তু যেখানে অগ্রসরণের পথ রুদ্ধ, সেখানে কর্মহীনতার বিশাল অবকাশ মানসক্ষেত্রকে শয়তানের কারখানায় পরিণত করে।দেশব্যাপী আশাহীনতা, কুরুচি ও দুর্নীতিপূর্ণ চলচ্চিত্র প্রদর্শনী ছাত্রসমাজকে উচ্ছৃঙ্খলতার পথে পরিচালিত করে।ছাত্রসমাজে যদি শৃঙ্খলাবোধ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হয়, তবে তাদের উচ্ছৃঙ্খলতার মূল কারণগুলোকে খুঁজে নিয়ে তা বিলুপ্ত করতে হবে।ছাত্রসমাজেরও মনে রাখতে হবে যে, ছাত্রজীবনই জীবন গঠনের প্রকৃত সময়, জীবনের প্রস্তুতির কাল।এসময় থেকে সুশৃঙ্খল জীবন যাপন না করলে ভবিষ্যতে সাফল্য আশা করা যায় না।

নিয়মানুবর্তিতার গুরুত্বঃ

ব্যক্তিগত, দৈহিক, নৈতিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক সর্বক্ষেত্রে উন্নতির জন্য শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবন যাপন আবশ্যক।স্বাস্থ্য রক্ষায় নিয়মভঙ্গ করলে দেহ রোগাক্রান্ত হতে বাধ্য।আত্মসংযমে অসমর্থ হলে মানুষ ইন্দ্রিয়ের দাস হয়ে পড়বেই।এর ফলে নৈতিক চরিত্রের অবনতি অনিবার্য।বিক্ষিপ্ত মনকে যদি শৃঙ্খলার শাসনে বাঁধতে পারা না যায়, তবে বিদ্যাচর্চা করা কিভাবে সম্ভব? কাজেই, জীবনের সর্বক্ষত্রে শৃঙ্খলা বা নিয়মানুবর্তিতার চর্চা করতে হবে।প্রয়োজনীয় বিধি- বিধান না মানলে সুন্দর জীবন গড়ে তোলা সম্ভব নয়।কল্যাণমুখী সুন্দর জীবন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা বা নিয়মানুবর্তিতার গুরুত্ব অপরিসীম।

উপসংহারঃ

মানুষ হিসেবে আমাদের প্রত্যেকের জীবনে যথাযথ শৃঙ্খলাবোধ থাকা প্রয়োজন।শৃঙ্খলাহীন জীবন হালছাড়া নৌকার মতো।যাকে বলে নীতিহীন জীবন।শৃঙ্খলাবোধের মাধ্যমে আমরা আমাদের ব্যক্তিগত জীবনেই শুধু নয়, জাতি জীবনে তথা সমগ্র মানবজাতির ক্ষেত্রে লাভবান হতে পারব, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।কবি বলেছেন-

নিয়মের পথ ধরে গড়লে জীবন

সফলতা নিয়ে আসে সুখের স্বপন।

গুণাবলি ফুটে ওঠে ছড়ায় যে খ্যাতি

কতনা সুনাম পায় দেশ আর জাতি।


Read More:
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url