বঙ্গবন্ধুর জীবনী নিয়ে রচনা লিখন

বঙ্গবন্ধুর জীবনী নিয়ে রচনা লিখন


বঙ্গবন্ধুর জীবনী

সূচনাঃ

বাঙালি জাতির ইতিহাসে অনেক জাতীয় নেতার আবির্ভাব ঘটেছে।বাঙালী জাতির এই অবিস্মরণীয় ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে তারা আজীবন আমাদের স্মৃতিতে গেঁথে থাকবেন।তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।তিনি আমাদের জাতির পিতা,জাতির অবিসংবাদিত নেতা,আমাদের স্বাধীন দেশের মহান স্থপতি।দেশ ও জাতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার অবদান অনস্বীকার্য।তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বাঙালি জাতি অর্জন করেছে সুদীর্ঘ লালিত স্বপ্নের স্বাধীনতা। 

 Some are born great

 Some achieve greatness, and

 Some have greatness trust upon them.

 -William Shakespeare

জন্মঃ

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।মধুমতি তীর-সংলগ্ন এই ছায়া ডাকা গ্রামে পিতা-মাতার কোল আলো করে জন্ম নিল একটি ছোট্ট শিশু; যার নাম রাখা হয় শেখ মুজিবুর রহমান।তিনি ছিলেন পরিবারের জ্যৈষ্ঠ সন্তান।বাবা-মা আদর করে তাকে "খোকা" বলে ডাকতেন।

বংশ পরিচয়ঃ

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টুঙ্গিপাড়ার প্রসিদ্ধ "শেখ পরিবারে" জন্মগ্রহণ করেন।তার বাবার নাম শেখ লুৎফুর রহমান এবং মাতা সায়েরা খাতুন।বাবা লুৎফুর রহমান পেশায় ছিলেন একজন দেওয়ানি আদালতের সেরেস্তাদার।

শিক্ষা জীবনঃ

পরিবারের মধ্য দিয়েই বঙ্গবন্ধুর লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয়।অতঃপর ১৯২৭ সালে সাত বছর বয়স থেকে তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবনের সূচনা ঘটে।কিন্তু একই স্কুলে তার পড়াশোনা ছিল না।মাত্র বারো বছর বয়সে তিনি বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হন।এবং তার পড়াশোনা প্রায় চার বছরের জন্য বন্ধ হয়ে যায়।এ সময় তার গৃহশিক্ষক ছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী আবদুল হামিদ মাস্টার।ধারণা করা হয়, বঙ্গবন্ধুর রাজনীতিতে যোগদানের ক্ষেত্রে গৃহশিক্ষকের প্রভাব বিদ্যমান ছিল।অতঃপর ১৯৩৭ সালে তিনি গোপালগঞ্জ মিশন হাইস্কুলে ভর্তি হন।এবং ১৯৪২ সালে এই স্কুল থেকেই প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।পরবর্তী শিক্ষা জীবন শুরু হয় তার কলকাতা মহানগরে।১৯৪৭ সালে তিনি কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন।এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন।কিন্তু ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ধর্মঘটকে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ায় কর্তৃপক্ষ তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করেন।বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা জীবন এভাবেই অসমাপ্ত থেকে যায়।

রাজনৈতিক জীবনঃ

ছাত্রজীবন থেকেই বঙ্গবন্ধু রাজনীতিতে যুক্ত হন।পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু ছিলেন প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর।১৯৪৮ সাল থেকেই ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে ।ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণের দায়ে তখন বঙ্গবন্ধুকে কারাবন্দী করা হয়। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।এছাড়া ১৯৬৬ সালে ছয় দফাকে কেন্দ্র করে তার রাজনৈতিক খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লে  তাকে আবার কারাবন্দি করা হয়।এছাড়াও ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে একটি মিথ্যা মামলা সাজিয়ে বঙ্গবন্ধুকে পুনরায় কারাবন্দি করা হয়।কিন্তু পূর্ব বাংলার জনগণ এর তীব্র প্রতিবাদ করে।ফলে বঙ্গবন্ধুর উপর থেকে মামলা উঠিয়ে নেওয়া হয়।বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ইতিহাসে তিনি ছিলেন বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী।

প্রাচীন বাংলাঃ 

প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই বাংলার মানুষ একটি নির্দিষ্ট ভূখন্ডে বাস করত।তবে প্রাচীনকালে পুরো বাংলা জুড়ে একক কোনো রাষ্ট্র গড়ে উঠেনি।তখন বাংলা বা বাংলাদেশ নামক কোনো দেশের অস্তিত্বই ছিল না।ধারণা করা হয়,তখনকার সময়ে গৌড়, বঙ্গ,পুন্ড্র,হরিকেল,সমতট,বরেন্দ্র প্রভৃতি জনপদ ছিলএবং বাঙালীর যাত্রা এইসব জনপদের মধ্যে দিয়েই শুরু হয়।এইসব জনপদে বিভিন্ন শাসক যে যার মতো রাজ্য শাসন করতেন।মূলত বিচ্ছিন্নভাবেই বাংলার ইতিহাসের যাত্রা শুরু হয়েছে

পরাধীনতা থেকে পরাধীনতাঃ

ঐশ্বর্যশালী বাংলার প্রতি বিদেশীদের ছিল লোলুপ দৃষ্টি।তাই বারংবার বাংলা একের পর এক বৈদেশিক ক্ষমতার হাতে বন্দি হয়েছে।প্রাচীন বাংলায় মৌর্য,গুপ্ত,সেন এবং পাল সম্রাটরা রাজত্ব করেছেন।মুসলিম শাসনামলে ১৩৫২ সালে প্রথমবারের মতো সমগ্র জনপদ একত্রে বাংলা নামে পরিচিত হয়।মুসলিম শাসনের পর সমগ্র বাংলা ব্রিটিশদের অধীনে চলে যায়।ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দীর্ঘ সংগ্রামের পর ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাজ্যের সৃষ্টি হয়।পাকিস্তান বিভক্ত হয় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান হিসেবে।দ

পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণঃ

পাকিস্তান গোড়া হতেই পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্যনীতি অনুসরণ করে আসছিল।রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈষম্য ক্রমাগত ত্বরান্বিত হতে থাকে।পাকিস্তানি শাসন ও শোষণের ফলে পূর্ব বাংলার সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হতে থাকে।পূর্ব বাংলার অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান পরিণত হয় সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা রাষ্ট্রে।অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তান তথা সোনার বাংলা পরিণত হয় শ্মশানে।

১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনঃ

পূর্ব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু ছিলেন সোচ্চার।১৯৪৮ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ গঠন করেন।এ বছরই ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে এবং ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণের দায়ে তাকে কারারুদ্ধ করা হয়।তাছাড়া ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে বহিষ্কার করেন।

ঐতিহাসিক ছয় দফাঃ

বাঙালির স্বাধিকারের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালে ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন।এটি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এক পরোক্ষ প্রতিবাদস্বরুপ এবং বাঙালি জাতির স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রথম এবং যৌক্তিক প্রস্তাবনা।এ কারণে ছয় দফাকে বলা হয় বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ।ছয় দফার এই আন্দোলনকে প্রতিহত করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুকে প্রধান আসামী করে ষড়যন্ত্রমূলক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়।

ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানঃ

এ সময় দেশের ছাত্রসমাজ ১১ দফা কর্মসূচি নিয়ে গণআন্দোলনে শরিক হয়।আন্দোলনের ভয়ে ভীত হয়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন।বন্দিদশা থেকে মুক্তিলাভের পর ১৯৬৯ সালে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক বিশাল ছাত্রজনতার সামনে তাকে "বঙ্গবন্ধু" উপাধিতে ভূষিত করা হয়।এবার আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রুপ নেয়।

সত্তরের নির্বাচনঃ

ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করে ১৯৭০ সালে নির্বাচনের ঘোষণা দেন।নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯ টি আসনের মধ্যে ১৬৭ আসন লাভ করে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করেন।এ অভূতপূর্বে বিজয়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।

৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণঃ

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ইতিহাসে ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।তৎকালীন সময়ে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চের ভাষণ দেন।এ ভাষণ ছিল মূলত বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের এক দিক-নির্দেশনা।তিনি সেদিন বজ্রকণ্ঠে বলেছিলেন-

 এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম

 এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।


স্বাধীনতার ঘোষণাঃ

২৫ শে মার্চ কালোরাতে পাকবাহিনী নিরীহ বাঙালিদের উপর "অপারেশন সার্চলাইট" নামক এক নারকীয় হত্যাযজ্ঞের সূচনা ঘটায়।এ ঘটনার পর ২৬ শে মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।তিনি বলেন-

This is may be my last message.From today,bangladesh is independent.

এর কিছুক্ষণ পরেই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়।

মুজিবনগর সরকার গঠনঃ

১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি করে মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়।১৭ই এপ্রিল মুজিবনগর সরকার শপথ গ্রহণ করে।মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলাকে কেন্দ্র করে এই সরকার গঠন করা হয়।মূলত মুক্তিযুদ্ধকে সুসংহত করা এবং সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার লক্ষ্যে মুজিবনগর সরকার গঠন করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয়ঃ

১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ থেকে বাংলাদেশ ছিল পাকিস্তানি হানাদারদের দখলে।কাজেই দেশকে শত্রুমুক্ত করার লক্ষ্যে দেশের সর্বস্তরের জনগণ ঝাপিয়ে পড়ে এই গণযুদ্ধে।ছাত্র-শিক্ষক,কৃষক-শ্রমিক,শিল্পী-সাহিত্যিক,বুদ্ধিজীবীসহ সকল স্তরের মানুষ প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়।নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর আমরা বিজয় অর্জন করি।

জাতির জনক উপাধিঃ

১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ ছাত্রলীগ আয়োজিত পল্টনের বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীন বাংলার "জাতির পিতা" হিসেবে প্রথম অভিহিত করা হয়।

স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এবং শাসন ক্ষমতা গ্রহণঃ

স্বাধীনতার পর ১০ই জানুয়ারি ১৯৭২ সালে বাঙালির প্রাণপ্রিয় নেতা স্বদেশের মাটিতে বীরের বেশে প্রত্যাবর্তন করেন।সেদিনও লাখ লাখ জনতা তাকে আনন্দ-অশ্রু দিয়ে বাংলার রক্তাক্ত মাটিতে স্বাগত জানায়।দেশের মাটিতে নেমেই যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলতে তিনি বদ্ধ পরিকর হন।কিন্তু বঙ্গবন্ধু দেশ পরিচালনা করতে পেরেছেন মাত্র সাড়ে তিন বছর।

বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতবরণঃ

বঙ্গবন্ধু তখন সমগ্র দেশকে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্রতে পরিণত করতে চেয়েছিলেন।কিন্তু  অপচক্র সেই সুযোগ তাকে দেয়নি।দেশি-বিদেশী স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের ষড়যন্ত্রে কতিপয় সেনা কর্মকর্তার দ্বারা ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট নির্মমভাবে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হন।

উপসংহারঃ

বঙ্গবন্ধুর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল আমাদের এই সোনার বাংলাদেশ।তিনি জীবনের শুরু থেকেই বাংলা এবং বাংলার মানুষকে গভীরভাবে ভালবেসে গিয়েছেন।তিনি অত্যাচার,শাসন-শোষণের পরেও অবিচল থেকেছেন বাঙালি জাতিকে মুক্ত করার সংকল্পে।তাইতো বাঙালি জাতি তাকে উপাধি দিয়েছে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে।তিনি বাংলার মানুষের হৃদয়ে অমর হয়ে থাকবেন।কবির ভাষায়-

 যতদিন রবে পদ্মা,মেঘনা,গৌরী,যমুনা বহমান

ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।

এই পর্যন্ত ছিল  বঙ্গবন্ধুর জীবনী নিয়ে রচনা লিখন। আরো রচনা পড়তে চাইলে,

বেগম রোকেয়া জীবনী; নারীমুক্তির অগ্রদূত

 

Next Post Previous Post