স্বদেশ প্রেম নিয়ে রচনা লিখন
স্বদেশ প্রেম
ভূমিকা:
মানুষ প্রকৃতপক্ষে এই পৃথিবীর সন্তান হলেও ভূ-রাজনৈতিক বিচারে একটি দেশের সন্তান। আপন ঘরের প্রতি মানুষের যেমন থাকে নাড়ির টান, স্বদেশের প্রতিও থাকে তেমনি হৃদয়ের আকর্ষণ। তখন হৃদয়েরজোড়া ভালোবাসায় কবির সঙ্গে বলতে ইচ্ছে করে :
আমার এই দেশেতেই জন্ম যেন এই দেশেতেই মরি
স্বদেশ প্রেম কী:
যে ভৌগলিক প্রেক্ষাপটে আমরা জন্মগ্রহণ করি এবং লালিত পালিত হয় তাই স্বদেশ। আমাদের দৈনন্দিন জীবনচর্চার মধ্যে দিয়ে স্বদেশের প্রতি নিবিড় অনুভূতিতে জড়িয়ে যাই। এই নিবিড় অনুভূতিই হল স্বদেশ প্রেম।
স্বদেশ প্রেমের চেতনা:
মানুষ জন্মের পর হতে স্বদেশের প্রকৃতি, পরিবেশ, সংস্কৃতির সঙ্গে গড়ে উঠে নিবিড় বন্ধন। স্বদেশের এসব উপাদানের মধ্যে দিয়ে নিজের জীবনকে বিকশিত করে। এভাবেই শিশুকাল হতেই স্বদেশপ্রেমের চেতনা জাগ্রত হয়।কবির ভাষায়:
সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে
সার্থক জনম মাগো, তোমায় ভালবেসে।
স্বদেশ প্রেমের প্রকাশ:
স্বদেশপ্রেমের প্রকাশের অন্যতম দৃষ্টান্ত হল দেশের সংকট মোকাবেলায় দেশপ্রেমিকদের এগিয়ে আসা।প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাজনৈতিক সংকট, মানবিক বিপর্যয়ে দেশপ্রেমিক ছুটে আসে।স্বদেশপ্রেমের প্রকাশের আরেকটি দৃষ্টান্ত হল স্বদেশ ত্যাগ না করা। বিদেশ গেলেও ফিরে আসার জন্য দেশপ্রেমিকের মন সবসময় ব্যাকুল থাকে।তার মনের অবস্থা হয় এইরকম:
বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি,তাই
আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর।
স্বদেশ প্রেম ও ধর্ম:
পৃথিবীর জনপ্রিয় ধর্মগুলোতে স্বদেশপ্রেমের প্রতি বিশেষ আলোকপাত করা হয়েছে।আরবীয় মনীষীদের মতে,
হুব্বুল ওয়াতানি মিনাল ঈমান
দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ।
মহানবী (স:) মক্কা ত্যাগকালে বারবার অশ্রুসজল মক্কার দিকে ফিরে তাকাচ্ছিলেন আর বলছিলেন,
হে আমার স্বদেশ!তুমি কত সুন্দর।আমি তোমাকে ভালোবাসি।আমার নিজ গোত্রের লোকেরা যদি ষড়যন্ত্র না করত, আমি কখনো তোমাকে ছেড়ে যেতাম না।
বিশ্ব প্রেম:
মানুষ একটি দেশের ভৌগলিক পরিসীমার মধ্যে বাস করলেও ব্যাপক অর্থে মানুষ পৃথিবীর অধিবাসী।স্বদেশপ্রেম বিশ্বপ্রেমেরই একটি অংশ।কারণ, স্বদেশ তো বিশ্বেরই অন্তর্ভুক্ত। কবিগুরুর ভাষায়,
সব ঠাঁই মোর ঘর আছে,
আমি সেই ঘর মরি খুঁজিয়া
স্বদেশ প্রেম ও বিশ্ব প্রেম:
স্বদেশপ্রেম যদি বিশ্বমৈত্রী ও আন্তর্জাতিক ভ্রাতৃত্বের সহায়ক না হয় তবে তা প্রকৃত দেশপ্রেম হতে পারে না। যখন স্বদেশকে একমাত্র পরমপ্রিয় মনে করে আমরা বিশ্বকে শত্রু মনে করি, তখন শুভ বিচারবুদ্ধি স্বদেশপ্রেমের অন্ধ আবেগে লুপ্ত হয়। ফলে পরস্পর হানাহানি এবং অবারিত রক্তক্ষয় অনিবার্যরুপে দেখা যায়।
স্বদেশ প্রেমের উজ্জ্বল প্রতিভূ:
এমন কিছু মানুষ প্রতিটি দেশে যুগে যুগে জন্মগ্রহণ করে থাকেন, যাঁরা স্বদেশপ্রেমের উজ্জ্বল প্রতিভূ হয়ে চিরকাল জাতির মাঝে বেঁচে রয়েছেন।আমাদের উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে যারা স্বরণীয় ও বরণীয়,তাদের মধ্যে রয়েছেন- মহাত্মা গান্ধী, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, মাওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ। তাছাড়া অন্যান্য অঞ্চলের মধ্যে ইতালির গ্যারিবাল্ডি, আমেরিকার জর্জ ওয়াশিংটন, চীনের মাও সেতুং, রাশিয়ার লেনিন, তুরস্কের মোস্তফা কামাল পাশা ও ভিয়েতনামের হো চি মিন প্রমুখ স্বদেশপ্রেমের উজ্জ্বল প্রতিভূ হিসেবে পরিগণিত।
উগ্র জাতীয়তাবোধ:
দেশপ্রেম যদি উগ্র জাতীয়তাবোধের জন্ম দেয়, তাহলে সেই উগ্র জাতীয়তাবোধ দেশে দেশে ও জাতিতে জাতিতে সৃষ্টি করে সংঘাতের পথ। এই উগ্র জাতীয়তাবোধ থেকেই জার্মানির হিটলার ও ইতালির মুসোলিনী সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়েছিল মহাযুদ্ধের বিষবাষ্প।যার ফলে বীভৎস মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল লক্ষ লক্ষ মানুষকে।
স্বদেশ প্রেম ও বাঙালি:
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে এবং সবশেষে ১৯৯০ সালের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বাঙালি জাতির স্বদেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।দেশের সংকটময় মুহূর্তে, পরাধীনতার বিষবাষ্পে স্বদেশপ্রেমিক মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঝাপিয়ে পড়েছিল এইসব সংকট উত্তরণে।
স্বদেশ প্রেম ও ছাত্রসমাজ:
ছাত্ররা শুধু দেশের ভবিষ্যৎই নই, তারা ভবিষ্যতের কর্ণধারও বটে। ভাবী কর্ণধাররা যদি দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ না হয়, তাহলে দেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন। বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতায় চোখ দিলে স্পষ্ট হয় যে, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে ছাত্রসমাজের ভূমিকাই ছিল মুখ্য।১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামেও তাদের ভূমিকা ছিল গৌরবময়।
স্বদেশ প্রেম ও রাজনীতি:
রাজনীতিবিদদের একটি অন্যতম সুপ্ত শর্ত হল দেশপ্রেম। স্বদেশপ্রেমে ব্রতী হয়েই রাজনীতিবিদরা রাজনীতির পাঠ নিয়ে থাকেন।যদি স্বদেশপ্রেম হৃদয়ে না থাকে তাহলে রাজনীতি হয়ে উঠে নিছক স্বার্থপরতা।
বাংলা সাহিত্যে স্বদেশ প্রেমের চেতনা:
সাহিত্য জনজীবনেরই প্রতিফলন।মধূসূদন, বঙ্কিমচন্দ্র হতে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, আবুল ফজল, জসীম উদ্দিন, শওকত উসমান, শামসুর রহমান প্রমুখ সাহিত্যিকদের রচনায় দেশাত্মবোধ একটি অপরিমেয় মমত্ববোধ ও মানসিক দৃড়তায় পরিস্ফুট হয়েছে। কবি,শিল্পী ও সাহিত্যিকরা দেশের বিরুদ্ধে যত ষড়যন্ত্র হয়েছে, সব কিছুর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন, জানিয়েছেন প্রতিবাদ।
স্বদেশ প্রেমের ভিন্ন রুপ:
স্বদেশপ্রেমের প্রকাশ শুধু দেশের ক্রান্তিলগ্নে বা সংকটময় মুহূর্তে সীমাবদ্ধ নয়। স্বদেশপ্রেমের ভিন্নরুপও বিদ্যমান। শিল্প-সাহিত্য চর্চা, জ্ঞান- বিজ্ঞান সাধনার মাধ্যমেও স্বদেশপ্রেম প্রকাশ পায়।বৌদ্ধিক বিকাশের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া স্বদেশপ্রেমের শক্তিশালী রুপ।
বর্তমান বাংলাদেশ ও স্বদেশ প্রেম:
পর্বতসমান দেশপ্রেমের চেতনা নিয়ে ১৯৭১ সালে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাণপণ লড়াইয়ে আমরা অর্জন করেছি স্বাধীনতা। স্বাধীনতার অনেক বছর অতিক্রান্ত হলেও বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক অবস্থা এখনো উন্নত নয় তুলনামূলকভাবে।এই অবস্থার জন্য অন্যতম কারণ হল দেশের মানুষের মধ্যে স্বদেশপ্রেমবোধের অভাব।তাই,সকল শ্রেণীপেশার মানুষের মধ্যে স্বদেশপ্রেমের চেতনা জাগ্রত করা হলে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের এক অপার সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে।
উপসংহার:
স্বদেশপ্রেম একটি চেতনা, একটি শক্তি, একটি বহমান নদী।স্বদেশপ্রেমের এই চেতনা যদি তেমন শক্তিশালী না হয়, তাহলে সে দেশের দুর্ভোগ অনিবার্য।
তাই তো কবি বলেছেন,
স্বদেশের উপকারে নাই যার মন
কে বলে মানুষ তারে,পশু সেই জন।
এই পর্যন্ত ছিল স্বদেশ প্রেম নিয়ে রচনা।আরো রচনা পড়তে চাইলে,
মাদকাসক্তি ও এর প্রতিকার নিয়ে রচনা লিখন
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস নিয়ে রচনা
বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প নিয়ে রচনা লিখন