মানব কল্যাণে বিজ্ঞান নিয়ে রচনা লিখন

মানব কল্যাণে বিজ্ঞান নিয়ে রচনা লিখন


মানব কল্যাণে বিজ্ঞান

ভূমিকা:

অতীতের  গুহাবাসী অসহায় মানুষ রহস্যময় জগৎ ও জীবনের দিকে ভয় ও বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে থাকত। সেদিন তার জীবন ছিল প্রকৃতি-নির্ভর।প্রকৃতির খেয়াল খুশিমত নিয়ন্ত্রিত হত তার জীবন প্রবাহ। আজ আধুনিক সভ্যতার যে উৎকর্ষ,ঐশ্বর্য ও গতিময় চেতনা তার অন্যতম নিয়ামক হল বিজ্ঞান।


বিজ্ঞান কিঃ

বিজ্ঞান বা Science শব্দটির উৎপত্তি 'Scio' হতে।  'Scio' শব্দের অর্থ জানা। হারবর্ট স্পেন্সরের মতে, বিজ্ঞান হল সঙ্ঘবদ্ধ জ্ঞানের সমষ্টি। 


বিজ্ঞানের উদ্ভব: 

বিজ্ঞানের উদ্ভবের মূলে রয়েছে মানুষের প্রয়োজন ও কৌতুহলচেতনা।প্রকৃতির কাছে অসহায় মানুষ প্রকৃতিরই নানা বিষয়ে অন্বেষণের এক পর্যায়ে বিজ্ঞানের প্রেরণা সৃষ্টি হয়।

প্রচলিত একটি প্রবাদ- 

Necessity is the mother of invention.


বিজ্ঞানের বিকাশ:

পৃথিবীর মানুষ  দিনে দিনে জ্ঞান অনেষণ করেছে,  হয়েছে আরো কৌতুহলী। ফলে বিজ্ঞানেরও বিকাশ ঘটেছে। একসময়কার অসহায় মানুষ আজ প্রকৃতির উপরও আধিপত্য বিস্তার করছে। কবির ভাষায়,

ধাক্কা দিয়ে তারায় তারায় সূর্যে গিয়ে ঠেকবো রে


আধুনিক বিজ্ঞান:

বিজ্ঞানের অভিযান শুরু হয়েছে সুদূর অতীতে। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীতে বা আধুনিক যুগে এর অগ্রগতি বিস্ময়কর। বিজ্ঞানের ইতিহাসে  এই অগ্রগতি শুধু নিত্য ধাবমান নয় বরং দুর্বার গতিসম্পন্ন।


বিজ্ঞানের বিস্ময়কর আবিষ্কার:

গুহাবাসী আদিম মানুষের পাথরে পাথর ঘষে আগুন জ্বালানো থেকে শুরু হয় বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার। তারপর থেকেই  বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের অব্যাহত অগ্রযাত্রা।বিজ্ঞানবলে মানুষ জল-স্থল-অন্তরীক্ষ জয় করেছে, আবিষ্কার করেছে সুখস্বাচ্ছন্দ্য বিধান ও সংকট উত্তরণের বহুবিধ কৌশল-প্রযুক্তি।বিদ্যুৎ,আণবিক শক্তি,  কম্পিউটার, ফোন, ফ্যাক্স, স্যাটেলাইট,এয়ারকুলার, টিভি, ফ্রিজ,সিনেমা, কাগজ, কলম, বিভিন্ন চিকিৎসা ও ইঞ্জিনিয়ারিং উপকরণ প্রভৃতি বিজ্ঞানের বিস্ময়কর আবিষ্কার।

বিজ্ঞানের অদম্য জয়যাত্রা:

আধুনিক মানুষ যদি একবার পেছন পানে ফিরে থাকায়,  চিন্তা করে অরণ্যচারী আদিম মানুষের কথা, তাহলে তার সমগ্র অন্তর আপ্লুত হয়ে যাবে এক অপরিসীম বিস্ময়ে।বিজ্ঞানের বলে বলীয়ান হয়ে মানুষ আজ খনির অন্ধকারে আগুন জ্বালিয়েছে। বিজ্ঞানের সাহায্যেই দূরের নক্ষত্রলোকের খবর পেয়েছে মানুষ,গ্রহলোক সম্বন্ধে আহরণ করেছে নতুন নতুন তথ্য।


কৃষিউন্নয়নে বিজ্ঞান:

কৃষিক্ষেত্রে বিজ্ঞান যুগান্তকারী অবদান রেখেছে। চাষাবাদে যান্ত্রিক প্রযুক্তির উদ্ভাবন করে কৃষিকে প্রকৃতির নির্ভরতার কবল হতে উদ্ধারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।যান্ত্রিক প্রযুক্তি ছাড়াও রাসায়নিক সার, কীটনাশকের ব্যবহার  বিজ্ঞানের উল্লেখযোগ্য অবদান। বর্তমানে আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করে বিজ্ঞানিরা উন্নত জাতের অধিক ফলনশীল বীজ তৈরি করছে।এর ফলে মরুভূমির মত উষর জায়গায় কৃষিকাজ সম্ভব হয়েছে।এছাড়াও সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করে অনাবৃষ্টি অঞ্চলে কৃত্রিমভাবে বৃষ্টিপাত ঘটানো সম্ভব হচ্ছে। এভাবে কৃষিকাজে বিজ্ঞান বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করেছে।


চিকিৎসাক্ষেত্রে বিজ্ঞান:

চিকিৎসাক্ষেত্রে আশ্চর্য সব উদ্ভাবনের গুণে রোগী ভরসা পাচ্ছে আরো কিছুদিন পৃথিবীর জীবনকে উপভোগ করার।অতীতের অনেক দুরারোগ্য ব্যাধির প্রতিষেধক আবিষ্কার হচ্ছে।  পেনিসিলিন, এন্টিবায়োটিক,  রেডিয়াম প্রভৃতি চিকিৎসাজগতে এক যুগান্তর সৃষ্টি করেছে।প্লাস্টিক সার্জারির মানুষ ইচ্ছেমতো চেহারা তৈরি করছে। কৃত্রিম হৃদপিণ্ড তৈরি করে তা মানুষের দেহে সংযোজন করে রোগীকে দীর্ঘদিন বাঁচিয়ে রাখার কৃতিত্ব পূর্ণ উদাহারণও বিজ্ঞান সৃষ্টি করছে।


যোগাযোগ ক্ষেত্রে বিজ্ঞান:

বিজ্ঞানের বদৌলতে মানুষ আবিষ্কার করেছে দ্রুতগামী যানবাহন, বুলেট ট্রেন ও শব্দের গতিবেগের উড়োজাহাজ।মানুষ আজ পৃথিবীর এক প্রান্তে বসে অপর প্রান্তের মানুষের সাথে কথা বলতে পারে। টেলিভিশন, মোবাইল,  ই-মেইলের মাধ্যমে সারা বিশ্বের খবর যেকোন মূহুর্তে পেয়ে যেতে পারে।স্যাটেলাইট ব্যবহার করে পৃথিবীর যেকোন প্রান্তের খবরাখবর, তথ্য ও ছবি সংগ্রহ করা যায়।ইন্টারনেটের মাধ্যমে যে কোন তথ্য পৃথিবীর এক প্রান্ত হতে অপর প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছে।এভাবে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি পুরো পৃথিবীকে হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে।


শিক্ষাক্ষেত্রে বিজ্ঞান:

শিক্ষাক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অবদান অনস্বীকার্য। শিক্ষার প্রয়োজনীয় উপকরণগুলোর বেশিরভাগই বিজ্ঞানের অবদান। কাগজ আবিষ্কারের মাধ্যমেই  এক অঞ্চলের জ্ঞান অন্য অঞ্চলে ছড়িয়ে যায়৷ পরবর্তীতে  ইন্টারনেটের মাধ্যমে তথ্যের আদান প্রদান আরো সহজতর হয়ে উঠে। করোনা মহামারীর সময় শিক্ষা কার্যক্রম স্থগিত হয়ে থাকেনি, বরং বিজ্ঞানের কল্যাণে অনলাইনে ক্লাস, পরীক্ষা সব শিক্ষামূলক কার্যক্রম সম্পাদিত হয়েছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে আমরা দ্রুতই  বিশ্বের  একপ্রান্ত হতে অন্যপ্রান্তের বই থেকে শুরু করে সব শিক্ষা উপকরণ আদান-প্রদানে সক্ষম হচ্ছি।


আবহাওয়া বিজ্ঞান:

মানুষের জীবনযাত্রার অনেকাংশ কাজই নির্ভর করে আবহাওয়ার উপর। মহাকাশে প্রেরিত কৃত্রিম উপগ্রহের সাহায্যে ৭/৮ দিন আগে থেকেই আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। ফলে আসন্ন ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাস হতে  রক্ষার জন্য আগাম প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব হচ্ছে।


মহাকাশ গবেষণায় বিজ্ঞান:

মহাকাশ গবেষণায় বিজ্ঞানের অগ্রগতি বিস্ময়কর।অনেক দিন আগেই মানুষ চন্দ্র জয় করেছে।এখন তার অভিযান চলছে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে।নক্ষত্রগুলোর নানা রহস্য,  মহাজাগতিক রশ্মি, উল্কাপিন্ডের পতন প্রভৃতি বিষয়ে কৃত্রিম উপগ্রহগুলো অজস্র তথ্য প্রেরণ করছে।


ইঞ্জিনিয়ারিং কলাকৌশলে বিজ্ঞান:

মানব কল্যাণে ইঞ্জিনিয়ারিং কলাকৌশলের অবদান অপরিসীম। প্রযুক্তির সাহায্যে মানুষ পাহাড় কেটে রাস্তা নির্মাণ করছে, টানেল গড়ছে, সেতু বানাচ্ছে।খরস্রোতা নদী, দুর্গম বনপথ, ভয়ঙ্কর মরুপ্রান্তরকে যেন অবলীলায় অতিক্রম করছে মানুষের গড়া পথ।


পরমাণবিক যুগে বিজ্ঞান:

বিজ্ঞানের নিরন্তর সাধনায় মানবসভ্যতা এখন পারমাণবিক যুগে এসে উপনীত হয়েছে।পৃথিবীতে ক্রমেই প্রাকৃতিক শক্তির উৎস নি:শেষ হয়ে আসছে। কিন্তু বিজ্ঞান মানুষকে পরমাণুর শক্তি হতে প্রাপ্ত অফুরন্ত শক্তির উৎসের সন্ধান দিয়েছে।


বিজ্ঞান ও মানবজীবন:

বিজ্ঞান আমাদের অন্তর্জীবনকে প্রভাবিত করেছে, বহির্জীবনেও নিয়ে এসেছে নানা পরিবর্তন।যে নিশীথ অন্ধকার যুগ যুগ ধরে শিশুমনে ছড়িয়ে দিত আদিদৈবিক শক্তির ভয়বিহ্বলতা, ভাগ্যবিধ্বস্ত রোগাক্লান্ত মানুষ একদিন রোগমুক্তির আশায় বার বার ছুটে গিয়েছে অন্ধদেবতার দুয়ারে। বিজ্ঞান এইসবকে বশীভূত করল এবং মুমূর্ষুকে দিল প্রাণের আশ্বাস, অন্ধকারকে আলোর সন্ধান।


দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞান:

বিজ্ঞান আমাদের দিয়েছে বিস্তৃতি,ঘুচিয়ে দিয়েছে স্থানিক সংকীর্ণতা। প্রতিদিন প্রভাতের কলরবের সঙ্গে  সঙ্গে সংবাদপত্র  বা ইন্টারনেট আমাদের ঘরে পৌছে দেয় বিশ্বের অসংখ্য সংবাদ কণিকা। ঘুম থেকে উঠে শুতে যাওয়া পর্যন্ত বিজ্ঞানের অকৃপণ দাক্ষিণ্য গ্রহণ করি।।অভ্যস্ত জীবনধারায় কোন ছন্দপতন ঘটলেই বুঝতে পারি, আমাদের প্রাত্যাহিক জীবন কতটা বিজ্ঞান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। যেমন: সন্ধ্যায়  হঠাৎ যখন বিদ্যুৎ চলে যায়, গভীর অন্ধকারে পতিত হয় : তখনই বিজ্ঞানের মহিমা বুঝতে পারি।শুধুই প্রয়োজনীয় কাজই নয়, প্রিয় মুখকে যেমন ধরে রাখতে পারি সেলুলয়েডের স্বচ্ছ আধারে,  তেমনি প্রিয় কন্ঠকেও চিরকালের জন্য বেঁধে দিতে পারি টেপের অদৃশ্য রেখা তরঙ্গে। বস্তুত আমাদের দৈনন্দিন জীবনটাই বিজ্ঞান নিয়ন্ত্রিত।


বিজ্ঞানের অপকারিতা:

বিজ্ঞানের সীমাহীন উপকারের পাশাপাশি রয়েছে কিছু অভিশপ্ত দিক।দ্রুত শিল্পায়ন,যন্ত্রনির্ভর কারখানা ইত্যাদি আজ বিশ্ব পরিবেশকে ঠেলে দিচ্ছে ধ্বংসের পথে।নষ্ট করে দিচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য।এছাড়া বিভিন্ন মারণাস্ত্রের মহাযজ্ঞ মানুষকে অস্তিত্ব সম্পর্কে সংশয়াকুল করে তুলেছে।বিজ্ঞানের অপব্যবহারেই হিরোশিমা-নাগাসাকির মত সমৃদ্ধ জনপথ ধংসযজ্ঞে পরিণত হয়েছে।


বিজ্ঞান ও আমাদের সমাজ:

বিজ্ঞানের আশীর্বাদপুষ্ট আধুনিক জীবনের উপকরণ ও প্রাচুর্য এ দেশের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয় নি।কারণ দেশের অধিকাংশ লোক দরিদ্র ও নিরক্ষর।অনেকাংশে এখনো প্রকৃতির দাক্ষিণ্যনির্ভর।আজো তারা জলের জন্য আকাশে চেয়ে থাকে অপলক দৃষ্টিতে। 


উপসংহার:

বিজ্ঞান মানব সভ্যতা বিকাশে এক অনন্য অভিযাত্রী। বিজ্ঞান শক্তির কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করা অভিপ্রেত নয়, আবার তার দৈনন্দিন ব্যবহার থেকে বঞ্চিত থাকাও অধিকতর দুর্ভাগ্যের।দৈনন্দিন জীবনে মানুষ বিজ্ঞানের কল্যাণে উপকৃত ও সমৃদ্ধ হোক। 

আমাদের সর্বোচ্চ সাফল্য 

অতীতেরগুলো নয়।

কারণ আমাদের নিয়তি

অপেক্ষা করছে সুদূর উচ্চতায়

 

এই পর্যন্ত ছিল মানব কল্যাণে বিজ্ঞান নিয়ে রচনা।আরো রচনা পড়তে চাইলে,

 মাদকাসক্তি ও এর প্রতিকার নিয়ে রচনা লিখন

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস নিয়ে রচনা 

বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প নিয়ে রচনা লিখন

নিয়মানুবর্তিতা/শৃঙ্খলাবোধ নিয়ে রচনা 

সময়ানুবর্তিতা/সময়ের মূল্য নিয়ে রচনা লিখন