মেরি শেলি;অন্তরালে লুকিয়ে থাকা আলোকবর্তিকা

মেরি শেলি;অন্তরালে লুকিয়ে থাকা আলোকবর্তিকা
 

মেরি শেলি;অন্তরালে লুকিয়ে থাকা আলোকবর্তিকা

মেরি শেলি; নাম শুনলেই কেমন যেন গায়ে কাটা দিয়ে উঠে।মনে পড়ে সেই বিশালদেহী দানব ফ্রাঙ্কেনস্টাইন এর কথা।যার কথা উঠলেই মেরির কথা সবাইকে মনে করিয়ে দেয়।আজ থেকে প্রায় দুইশ বছর আগে ইউরোপের জেনেভা লেকের ধারে এক বাড়িতে বসে উনিশ বছরের এক প্রাণচঞ্চল মেয়ে লিখেছিল পৃথিবীর প্রথম বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী।যার হাত ধরেই এই সৃষ্টিশীল কাব্যের শুরু, তিনিই মেরি শেলি।যার অন্যতম পরিচয় তিনি বিখ্যাত কবি পার্সি বিসি শেলির প্রিয়তমা।এবার প্রিয়তমা মেরিকে নিয়ে একটু দেখা যাক-

১৭৯৭ সালে ইংল্যাণ্ডের রাজধানী লন্ডনে জন্মগ্রহণ করেন এই প্রতিভাধর বিস্ময়।পিতা ছিলেন প্রখ্যাত রাজনৈতিক দার্শনিক এবং মুক্তমনা লেখক উইলিয়াম গডউইন।মাতা ছিলেন নারীবাদী সমাজসেবিকা মেরি উলস্টনক্রাফট।লন্ডনের আর দশটা শিশুর চেয়েও মেরির শৈশব ছিল একটু আলাদা।

মেরির যখন মাত্র এক মাস বয়স; সেই সময়েই তিনি মাতৃহারা হন।বাবা গডউইন নতুন বিয়ে করেন এবং সেখানে জন্ম নেয় ম্যারির সৎ বোন ফ্যানি ইমলে।মেরির সৎ মা মেরিকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় পারদর্শী করতে আগ্রহী ছিলেন না।তাই মেরির লেখাপড়ার সম্পূর্ণটা ছিল নিজের আগ্রহে এবং বাড়িতে থেকে থেকে।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাবঞ্চিত কিশোরী মেরির দিন কাটত একা একা।দিনের বেশিরভাগ সময়ই বাবা- মায়ের তৈরি লাইব্রেরিতে তিনি পড়ে থাকতেন।সারাদিন শুধু বই আর বই।বইয়ের সাথে সখ্যতায় ধীরে ধীরে তার একাকিত্ব দুর হতে থাকে।বইয়ের নেশায় মত্ত মেরিকে মাঝে মাঝে মায়ের কবরের পাশেও বই পড়া অবস্থায় পাওয়া যেত।ধীরে ধীরে মেরির মধ্যে সাহিত্যের অঙ্কুরোদগম হয়।বাবা গডউইন সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি হওয়ার কারণে তার বাসায় প্রায়ই সমাজের ওই শ্রেণির লোকদের আসা- যাওয়া থাকত।তার মধ্যে বিখ্যাত কবি স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজও ছিলেন।কবির সান্নিধ্যে থাকতে থাকতে মেরির কাব্য প্রতিভার বিকাশ ঘটে।পরবর্তীকালে যে মস্তিষ্কের কন্দরে স্ফুরিত হবে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন উপন্যাসের ধূসর চরিত্ররা, তার বীজ বপন হয়ে যাচ্ছিল শৈশবেই।

১৮১৪ সালে পার্সি বিসি শেলির সাথে আলাপ হয় মেরি গডউইনের।দুইজনের মধ্যে এক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠে।পি বি শেলি ছিলেন বিবাহিত, হ্যারিয়েট ওয়েস্টব্রুকের স্বামী।কিন্তু ধীরে ধীরে তাদের সম্পর্কে ফাটল ধরে।তখনই মেরি আর পি বি শেলী একে অপরের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া শুরু করে।সতের বছরের এক অনভিজ্ঞা কুমারী মেয়ে ভেসে গেল বাইশ বছরের ধীসম্পন্ন যুবকের বন্য অপার্থিব ভালবাসায়।

মেরী ভেবেছিলেন বাবা গডউইন তাদের এই সম্পর্ক মেনে নিবে।কিন্তু উইলিয়াম গডউইন মেয়ের এই প্রেম মেনে নিলেন না।ফলশ্রুতিতে ওই বছরেই তারা দুজনে গোপনে পালিয়ে যান ফ্রান্সের উদ্দেশ্যে।

কখনো গাধা, কখন অশ্বেতর, অথবা ঘোড়ায় টানা গাড়ি, আবার কখনো শুধুই পদব্রজে প্যারিস থেকে সুইজারল্যান্ডের দিকে যাত্রাকালীন মেরি দেখতে পান যুদ্ধ বিধ্বস্ত ফ্রান্সের অবস্থা।হাতে টাকা না থাকার কারণে মাঝপথে তাদের অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়।এমতাবস্থায় মেরি বুঝতে পারেন তিনি গর্ভবতী।কিন্তু জন্মের পরপরই শিশুটি মৃত্যুবরণ করেন।কিন্তু সন্তানের মৃত্যুশোক কেটে উঠার আগেই তিনি পুনরায় আবার মা হন।জন্ম নিলো তাদের পুত্রসন্তান উইলিয়াম।

পি বি শেলি মেরির সাহিত্য প্রতিভা সম্পর্কে অবগত ছিলেন।তাই পি বি শেলি সবসময়ই মেরিকে লেখার জন্য অনুপ্রেরণা দিতেন। ১৮১৬ সালে এই প্রেমিক দম্পতি সপরিবারে জেনেভায় লর্ড বায়রনের বাড়িতে আমন্ত্রিত হন।সেদিন রাতে লর্ড বায়রন সবাইকে ভুতের গল্প লেখার আহ্বান করে বসলেন।সবাই সানন্দে রাজি হয়ে যায়।সবাই গা- ছমছমে ভ্যাম্পায়ার- ড্রাকুলা ভিত্তিক গল্প লিখে বসে থাকল।

কিন্তু মেরি, তিনি কোন ড্রাকুলা বা ভ্যাম্পায়ারের গল্প লিখলেন না।জীবনের বহু উত্তান পতন দেখে ফেলা এই উনিশ বছরের মেয়ের মনে তখন এক অপার্থিব দানবের কথা ভেসে উঠে।লিখে ফেললেন সম্পূর্ণ সবার থেকে আলাদা এক ভয়ঙ্কর দানবকাহিনী, ফ্রাঙ্কেনস্টাইন।সম্পুর্ন ভিন্নধারার এই গল্প যেন মেরির লুকায়িত প্রতিভার প্রকাশ।প্রথমে ছোট গল্প হিসেবেই লিখবেন ভেবেছিলেন মেরি, কিন্তু পি বি শেলির অকুণ্ঠ উৎসাহে তিনি এক উপন্যাস রচনা করে ফেলেন।নিজের জীবনের দর্শন, সমাজচেতনা, একাকীত্ব, পালিয়ে বেড়ানোর ভয়, মানুষের যুদ্ধলিপ্সা, সমাজের চোখে খারাপ মেয়ে হিসেবে চর্চিত হওয়ার কষ্ট এই সবই তিনি তুলে ধরেন তার মেঘে ঢাকা ভয়ঙ্কর কালজয়ী এই উপন্যাসে।এর মাধ্যমে সাহিত্যপ্রেমীরা এক নতুন মাত্রার সাহিত্যরস আবিষ্কার করার সুযোগ লাভ করে; যার নাম বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী।

১৮১৬ সালে শেষ দিকে আবার দুজনে ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন।এসে জানতে পারেন পি বি শেলির প্রথমা স্ত্রী হ্যারিয়েট আত্মহত্যা করেছে।দ্বিতীয়ত, মেরির সৎ বোন ফ্যানিও আত্মহত্যা করেন।স্ত্রীর মৃত্যর পর পি বি শেলি মেরিকে বিয়ে করার জন্য উঠেপড়ে লাগেন।এবারে বাবা গডউইন সম্মতি দেয়।এবং তারা দুজনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।প্রেম এবার পরিণতি পায়।

সবাই বলে, সুখের পর দুঃখ আসে।এখানেও তার ব্যতিক্রম হলো না।তাদের প্রাণপ্রিয় পুত্র উইলিয়াম মারা যায়।মেরি আবার গর্ভবতী হয়।কিন্তু সেখানেও বিপত্তি।শেলি আর মেরির পিছন থেকে দুঃখ যেন সরছেই না।দুঃখ শেষ না হতেই বিরাট দুঃসংবাদ এসে হাজির হলো মেরির উপর।তার চব্বিশ বছর বয়সে তার জীবনের একমাত্র ভালবাসা বিদগ্ধ প্রেমের কবি পার্সি বিসি শেলি, তার প্রাণপ্রিয় স্বামী মারা যায় নৌকাডুবি হয়ে।স্বামীকে হারিয়ে পাগলের মত হয়ে যান মেরি।

ধীরে ধীরে আবার উঠে দাড়ান মেরি।বেশ কিছুদিন অর্থাভাবে থাকার পর আবারও লেখালেখিকে পেশা হিসেবে বেছে নেন তিনি।ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের মত সাড়া জাগানো উপন্যাস বাদেও তিনি আরো ছয়টি উপন্যাস, তিনটি শিশু সাহিত্য, অজস্র ছোট গল্প ও কবিতা, তাদের ছয় সপ্তাহের যুদ্ধ বিদ্ধস্ত ইউরোপ যাত্রা সংক্রান্ত এক ভ্রমণবিষয়ক লেখা ইত্যাদি।তিনি বিভিন্ন মানুষের জীবনীও লিখেছিলেন।

মাত্র তিপ্পান্ন বছর বয়সে ১৮৫১ সালে ইংল্যান্ডের লন্ডন শহরে ব্রেইন ক্যান্সারে তার মৃত্যু হয়।তিনি চিরতরে আমাদের থেকে হারিয়ে যান।কিন্তু তার অবিস্মরণীয় কীর্তি গুলো এখনো আমাদের মাঝে রয়ে গেছে।

পরিশেষে,

কি অদ্ভুতভাবে স্রষ্টাকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যায় সৃষ্টি।ফ্রাঙ্কেনস্টাইন উপন্যাস নিয়ে পৃথিবী জুড়ে যত মাতামাতি যত উল্লাস, তার এক অংশও মেরি শেলির জীবন নিয়ে হয় নি।তার দর্শন, চিন্তা ধারা কিছুকেই মানুষ মনে রাখেনি।জীবন- মৃত্যু, ন্যায়- অন্যায় ইত্যাদির তীব্র দোলাচলে আবদ্ধ ধীসম্পন্ন তরুনীর মননে তৈরি এই বই নিজেও বারংবার দোলাচল তৈরি করেছে মানুষের হৃদয়ে।মেরি শেলি; অভুতপূর্ব এক নারী।যার জীবনে কোনোকিছুই স্থায়ী ছিল না।সবকিছুই ক্ষণস্থায়ী।প্রেম, ভালবাসা সব।দিনশেষে তিনি হারিয়ে গেছেন সবার অলক্ষ্যে।আজও যতদিন তার কীর্তি বেচে থাকবে তিনি আমাদের মাঝে অমর হয়ে থাকবেন।


Read More:

Post a Comment

Please don't share any link.
© Bihongom . All rights reserved. Developed by Jago Desain