অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক সাক্ষাৎকার
আব্দুর রাজ্জাক স্যারের সাক্ষাৎকার
চিরাচরিত সমাজ ব্যবস্থা এবং প্রথাগত ভূয়োদর্শন যেখানে বেশি উঁচুতে না ওঠার কিংবা বেশি না বাড়ার উপদেশ দেয় সেখানে মহৎ ব্যক্তি বা ব্যক্তিত্বের দেখা পাওয়া মেলা ভার।এই জ্ঞানদুর্ভিক্ষে উঠে আসে একজন অনন্য পুরুষ; অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক স্যার।সত্তর বছর ধরে যিনি জ্ঞানের তপস্যা করেছেন।জ্ঞানের সব জগতে ঘুরেও তিনি রয়ে গেছেন ঠিক সাধারণ।চারপাশের অগণিত উল্লাসপূর্ণ জীবনযাপন থেকে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ আলাদা।যার কাছে সংসারজীবন ছিল নিতান্তই গৌণ, জ্ঞানচর্চাই ছিল মূখ্য।হুমায়ুন আজাদ বলেন,
এ সাধারণত্বকেই তো অসাধারণ করে তুলেছেন নিজের জীবনে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক; একালের জ্ঞানতাপস শুধু জ্ঞানের জন্যে জীবনকে অবহেলা করে গেলেন।জ্ঞানের কাছে জীবন পরাভূত হলে জন্ম নেন একজন অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক।
এই মহৎ ব্যক্তিত্বের সাথে হুমায়ুন আজদের করা সাক্ষাৎকারের কিছু অংশ নিম্নে বলা হলো-
১।প্রশ্ন- আপনি কি মনে করেন যে উপাচার্য হওয়ার জন্যে পন্ডিত হওয়া দরকার?
উত্তর- না, একেবারেই না।উপাচার্য পদটাতো বুড়ো বয়সে পান্ডিত্যের পুরষ্কার না।উপাচার্য
পদের জন্য দরকার ভালো প্রশাসক, পন্ডিতের দরকার নাই।
২।প্রশ্ন- আপনি কি মনে করেন যে, পন্ডিত না হ’লেই ভালো প্রশাসক হয়? যে- শিক্ষকেরা
লেখাপড়া করেন না, শুধু তাঁরাই উপাচার্য হওয়ার যোগ্য?
উত্তর- না, তা না।এ- পর্যন্ত উপাচার্য হয়েছেন তাঁদের মধ্যে হার্টগ আর মাহমুদ
হোসেন ছাড়া কারোরই কোনো স্পষ্ট লক্ষ্য ছিলো না। তাঁরা শুধু চাকরি করেছেন।তাঁরা সার্থকও
নয়, ব্যর্থও নয়।কারন কোনো লক্ষ্য থাকলেই তো শুধু সার্থকতাব্যর্থতা নির্ণয় করা যায়।যাঁদের
কোনো লক্ষ্য নাই তাঁদের আবার সার্থকতাব্যর্থতা কি? যদি কারো দালানকোঠা বানানোর লক্ষ্য
থাকে, আর যদি বানাতে পারে, তবে তাঁকে বলতে পারি সার্থক।যেমন মাহমুদ হোসেন।তিনি মনে করতেন
পন্ডিত হওয়ার শক্তি তাঁর নেই।তিনি দালানকোঠা বানাতে চেয়েছিলেন।কেউ যদি জ্ঞানচর্চার
জন্যে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে চায়, আর তাতে সার্থক হয়, তাহলে তাকে বলতে পারি সার্থক।এমন কেউ
নাই।প্রায় সব উপাচার্যের লক্ষ্যই ছিল চাকরি করা।
৩।প্রশ্ন- ক্লাসে বক্তৃতা দিতে কেমন লাগতো আপনার?
উত্তর- খুব খারাপ।ছাত্রদের মুখের দিকে চাইলেই খুব মায়া হতো।মনে হতো আহা, ওদের
কোনো কিছুতেই কোনো আগ্রহ নাই।আমার কথা তো নয়ই।দু- একটি ছাত্র আমাকে জানিয়েছিলো আমি নাকি
এক আধটি ছেলের মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে বক্তৃতা দিয়ে যেতাম।পুরোনো কলাভবনে আমার
ক্লাসের পাশেই ছিলো একটি পুকুর।সেই পুকুরে হাঁস ভাসতো অনেকগুলো।আমি জানালার বাইরে পুকুরের
হাঁসগুলোর দিকে তাকিয়ে বক্তৃতা দিয়ে ঘন্টা শেষ করতাম।
৪।প্রশ্ন- আপনি কখনো কোনো নারীকে স্পর্শ করেছেন, হাত ধরেছেন কোনো নারীর?ধরার
আবেগ বোধ করেছেন?
উত্তর- না।আমাদের সমাজব্যবস্থা যা তাতে আত্মীয় ছাড়া আর কোনো নারীর সংস্পর্শে
আসারই সুযোগ ছিল না।আত্মীয় যারা তাদের সাথে সম্পর্ক ছিলো আইনকানুনে বাঁধা, কার সঙ্গে
কেমন ব্যবহার করতে হবে তা আগে থেকেই স্থির করা ছিলো।কারো জন্য বিশেষ আবেগ জাগার ঘটনা
তো মনে পড়ে না।মেয়ে দেখলে তো আবেগ জাগবে, মেয়েই তো দেখি না।
৫।প্রশ্ন- শ্রেণীহীন সমাজব্যবস্থা আমাদের জন্য কতোটা দরকার?
উত্তর- আর্থনীতিক অসাম্য থাকা উচিত না, বেশি অসাম্য থাকা ভয়ঙ্কর।একেবারে থাকবে
না, এটাকে বাস্তবসম্মত লক্ষ্য ব’লে মনে হয় না।ষাট বছর কেটে যাওয়ার পরেও সোভিয়েত ইউনিয়নে
শতকরা দশজন লোক কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য, আর ওই শতকরা দশজন লোকই সব কিছু স্থির ও নিয়ন্ত্রণ
করে।এটাতো অসাম্য দুর করার কথা না।আর্থনীতিক অসাম্য দুর হয়েছে, আর বেশি কিছু না।শুধু
অর্থনীতির উপর গুরুত্ব দিলে সমাজকে তো ঠিকমত সংজ্ঞায়িত করা হয় না।আমি যদি ব্যক্তি হিসেবে
মূল্য না পায় অথচ আমার আয় যদি অন্যের সঙ্গে সমান হয়,তবে তা মূল্যবান না।এটা ঠিকই সোভিয়েত
ইউনিয়নে আর্থ অসাম্য দুর হয়েছে।তবে তার জন্যে মূল্য দিতে হয়েছে।সেই মূল্য হচ্ছে নীতিনির্ধারণের
ক্ষেত্রে অবিমিশ্র অসাম্য।
৬।প্রশ্ন- আপনি তো আশাবাদী।
উত্তর-আমি জানিনা।আমি তথ্য নিই, আর তথ্যভিত্তি ক’রেই সিদ্ধান্তে পৌঁছি।
৭।প্রশ্ন-প্রথাগত ব্যাপার ও চিন্তার প্রতি কি আপনি শ্রদ্ধাশীল?
উত্তর-শুধু প্রথাগত ব’লেই কোনো কিছুকে উড়িয়ে দেয়ার প্রয়োজন বোধ করি না,আবার
প্রথাগত ব’লেই মেনে নেয়ার প্রয়োজনও বোধ করি না।
৮।প্রশ্ন-আপনাকে অতীত জ্ঞান বেশি সুখ দেয় নাকি নতুন চিন্তা?
উত্তর- নতুন মানে সত্যিকারভাবেই নতুন কথা খুব বেশি নাই।যদি আর্কিমিডিস আর
আইনস্টাইনের চিন্তার তুলনা করেন তাহলে পার্থক্যটা পর্বতপ্রমাণ।আর প্লেটো যা চিন্তা
করেছিলেন,এবং ওই সব বিষয়ে যে চিন্তা করে,তাঁর কথা যদি ধরি,তাহলে,পার্থক্যটা খুব বেশি
না।বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেই চিন্তার অগ্রগতি ঘটেছে অপরিসীম।আপনি যদি পৃথিবীর মানববিদ্যার
প্রধান ব্যক্তিদের এক জায়গায় বসিয়ে দিয়ে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে বলেন,তাহলে তাঁদের শতাব্দী
কেটে যাবে।কিন্তু যদি প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের প্রধান ব্যক্তিদের বসিয়ে দিয়ে সিদ্ধান্তে
পৌছোতে বলেন,তাহলে তাঁরা বারো ঘন্টার বেশি সময় নেবেন না।প্লেটো থেকে আজ পর্যন্ত চিন্তার
যে-অগ্রগতি ঘটেছে,তা ওই দ্বিতীয় শ্রেনীর মানুষদের শ্রমেই ঘটেছে।
৯।প্রশ্ন- শুনেছি বাজার করতে আপনি পছন্দ করেন?
উত্তর- খুব।নিয়মিত বাজার করা শুরু করেছি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেয়ার পর।রান্না
শিখেছি ছোটবেলায়ই।আমি যে- কোনো দেশে গেলেই দুটো জিনিস দেখি, একটা কাঁচাবাজার অন্যটা বইয়ের
দোকান।আমার মনে হয় কাঁচাবাজার আর বইয়ের দোকান সম্ভবত সমাজের অবস্থার সবচেয়ে উৎকৃষ্ট
নির্দেশক।যে- দেশে বইয়ের দোকান নাই সে- দেশে লেখাপড়া খুব হয় তা বিশ্বাস করি না।কাঁচাবাজার
দেখলেই বোঝা যায় দেশের অবস্থা কেমন।বইয়ের দোকানে গিয়ে কি ধরনের বই পাওয়া যায়, কেমন বিক্রি
হয়, তা দেখেই দেশের জ্ঞানচর্চার অবস্থা বোঝা যায়।একবার তুরস্কে গিয়েছিলাম।সেখানে বইয়ের
দোকান অজস্র, বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের বই প্রচুর পাওয়া যায়।সেখানে দোকানে শতকরা ত্রিশপয়ত্রিশটা
বই কম্যুনিজম সম্পর্কে, শতকরা ত্রিশপয়ত্রিশটা বই ইসলাম সম্পর্কে।সুতরাং ওই দেশে যে টেনশন
থাকবে তা বোঝার জন্য হাফেজ হওয়ার দরকার নাই।
১০।প্রশ্ন- সৃষ্টিশীল ও পন্ডিতদের মধ্যে কোন শ্রেনীটিকে আপনি গুরুত্বপূর্ন মনে
করেন?
উত্তর- গুরুত্বপূর্ণ তো নিঃসন্দেহে সৃষ্টিশীল মানুষ, তবে মানুষ হিসেবে তাঁরা
এমন যে তাঁদের সঙ্গে বাস করা খুবই কঠিন।আমরা শিক্ষকেরা তো পাণিনিও না, পাণিনির টীকাকার
মাত্র।
১১।প্রশ্ন- ভারতীয় নারীদের আপনার কাছে বেশি সুন্দর মনে হয় নাকি ইউরোপীয় নারীদের?
উত্তর- সৌন্দর্য্যের ক্ষেত্রে ভারতীয়- ইউরোপীয় শ্রেণীকরণ খুব সার্থক না।ভারতীয়দের
কাছে নারীর মুখের গঠন, এটা ওটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।ভারতীয় সুন্দরীরা ফিগার সম্বন্ধে অত্যন্ত
কম সচেতন।সব মিলেই যে সৌন্দর্য্য এ- বোধ নাই।চুল লম্বা, রং সাদা, দেখতে ভালো ইত্যাদিই
এখন প্রধান, কিন্তু ফিগারের দিকে চোখ নাই।এটাকে খুব সুষ্ঠু সৌন্দর্য্যবোধ বলা যায় না।ইউরোপে
ফিগারের ওপরে খুব বেশি মনোযোগ দেয়া হয়।ভারতীয় ভাস্কর্য, চিত্রকলায়ও তাই দেখা যায়, ফিগারের
দিকে দৃষ্টি নাই।নৃত্যরত শিবের ব্যাপারটা ভিন্ন, ওটা প্রায় গাণিতিক সুত্র অনুসারে তৈরি।তবুও
গ্রিক ভাস্কর্যে বিশুদ্ধ দেহসৌষ্ঠবের যে- উল্লাস দেখা যায়, ভারতে তা দেখা যায় না।
১২।প্রশ্ন- আপনি কোনো বই লিখলেন না কেনো?
উত্তর- আলস্যবশত।হয়তো বা জেনেছি, তাও খুবই অকিঞ্চিৎকর।তবে এটা প্রতারণাও হ’তে
পারে।
১৩।প্রশ্ন- আপনি আর কত বছর বাঁচবেন বলে আশা করেন?
উত্তর- আমি যে- কোনো মুহুর্তে বিদায়ের জন্য সম্পুর্ণ প্রস্তুত।কোনো দুঃখ নাই।কতো
বছর বাঁচবো, তা ভাবি না।জীবনমৃত্যু সম্পর্কে আমি বেশি ভাবি না।আমি অনেক বেঁচেছি, সত্তর
বছর।নিজের হাত জীবন নেবো, এই কথা কখনো ভাবি নাই, যে- কোনো মুহুর্তে মারা গেলে দুঃখ নাই।অনেক
তো বেঁচেছি।
তথ্যসূত্রঃ হুমায়ুন আজাদ সাক্ষাৎকার