রবার্ট ব্রাউনিং;প্রেম ও বিদ্রোহের কবি

রবার্ট ব্রাউনিং-robert browning

Robert Browning

একটি লম্বা সোনালী চুলের দড়িতে তার ছোট্ট গলার চারপাশে আমি ঘুরালাম তিনবার এবং তার শ্বাসরোধ করলাম।

-পরফিরিয়াস লাভার।

মানুষের জীবনের প্রকাশ একমাত্র কোথায় ঘটে? সাহিত্যের প্রতিটা ছন্দই মানুষের জীবনের এক- একটি আয়না।ছোট- বড় বাস্তবতার কথা, সুখ আর স্বপ্নের কথা সব তো বইয়ের পাতায় গাঁথা হয়।মানুষের জীবনের আশা, ভরসা, প্রেম, ভালবাসা সব কিছুরই প্রকাশ তো সাহিত্যেই ঘটে।সাহিত্যিকের লেখনী যেন সাধারণ মানুষের হৃদয়ের কালি।আজ এমন এক কবির কথা জানব; যার কবিতাকে বলা হয় ভগ্ন হৃদয়ের সান্ত্বনা, অশান্ত মনের প্রশান্তি।অন্যদের চেয়ে অনেকাংশেই আলাদা ব্যর্থতার এই কবি, রবার্ট ব্রাউনিং।যিনি জীবনকে শিল্পের চেয়ে অথবা অন্য যেকোনো কিছুর চেয়ে মূল্যবান মনে করেন।বিশ্বসাহিত্যের চির আশাবাদী কবি হলেন তিনি।

সময়টা তখন ভিক্টোরিয়া যুগ১৮১২ সালে লন্ডনে জন্মগ্রহণ করেন রবার্ট ব্রাউনিং।ভিক্টোরিয়ান যুগের একজন প্রসিদ্ধ কাব্য- নাট্যকার ছিলেন তিনি।বাবা সিনিয়র রবার্ট ব্রাউনিং; যিনি একজন ব্যাংকের কর্মচারি ছিলেন।মা সারা অ্যানা উইডম্যান; একজন পিয়ানোবাদক।তার বাবার প্রায় ৬০০০ বইয়ের একটি লাইব্রেরী ছিল।এই লাইব্রেরীর সংস্পর্শেই তার সাহিত্যচর্চা শুরু হয়।

শৈশবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বিরুদ্ধে ছিলেন তিনি।স্কুলের বাঁধাধরা নিয়ম তিনি পছন্দ করতেন না।তিনি মনে করতেন, জীবনের কাছে তিনি যা চান; স্কুল তা দিতে পারবে না।শোনা যায়, পাঁচ বছর বয়সেই তার লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয়।বাসায় বাবার বড় লাইব্রেরীই ছিল তার জ্ঞানচর্চার প্রধান উৎস।মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে ব্রাউনিং ফারসি, ল্যাটিন, গ্রীক ও ইতালীয় ভাষায় অসাধারণ দক্ষতা অর্জন করেন।

ব্রাউনিং এর সাহিত্যজীবন শুরুতে সফল হলেও ধীরে ধীরে তা অস্তমিত হতে শুরু করে।কোনো প্রকার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যতীতই তার জ্ঞানের জগৎ সকলের বিস্ময়ের কারন হয়ে দাঁড়ায়।মাত্র বারো বছর বয়সে তিনি প্রথম কবিতা লেখেন।কিন্তু কেউ প্রকাশিত না করার কারণে রাগে- অভিমানে নিজেই তা ছিঁড়ে ফেলেন।কলেজ, ইউনিভার্সিটি সবখানে ভর্তি হয়েও তিনি পড়ালেখা চালিয়ে যান নি; সাহিত্যেই তার মনোযোগ স্থির থাকে।

১৯৩০ সালের পর থেকে সাহিত্যে নিজেকে পুরোপুরি জড়িয়ে ফেলেন তিনি।প্রথমদিকে, সফল না হলেও কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি জনপ্রিয়ের শীর্ষে উঠে যান। ১৮৩৩ সালে তার লেখা প্রথম দীর্ঘ কবিতা Pauline: A Fragment of a Confession প্রকাশিত হয়।তার দীর্ঘ কবিতা তখন অনেকেরই নজর কাড়ে।এবং সমালোচনা ও প্রশংসায় আলোচিত হয়।ব্রাউনিং এর বিখ্যাত কবিতাসমূহের মধ্যে দ্য লাস্ট ডাচেস, দ্য লাস্ট রাইড টুগেদার, ফ্রা লিপো লিপি, অ্যা গ্রামারিয়ান ফিউনারেল ইত্যাদি অন্যতম।

এলিজাবেথ ব্যারেট; রবার্ট ব্রাউনিং এর প্রথম এবং শেষ প্রেম।ব্যারেট হচ্ছে ভিক্টোরিয়ান যুগের প্রথম শ্রেণির আরেক জনপ্রিয় কবি।শোনা যায়, এলিজাবেথ তখন ব্রাউনিং এর চেয়েও জনপ্রিয় ছিল।ছয় বছরের ছোট ব্রাউনিং এর সাথে ব্যারেটের এই অসম, নিষ্কাম, প্লেটোনিক প্রেম যেন সাহিত্যের জগতেই সম্ভব।তারা দুজন দুজনকে না দেখেই ভালবেসেছিল, প্রেমেও পড়েছিল।কবিতায় ছিল তাদের চলাচল করার বাহন; কবিতার মধ্য দিয়েই তাদের পরিচয়, প্রেম ও পরিণয়।

এলিজাবেথ ছিল চিররুগ্ন।বিছানায় শুয়ে বসেই তার দিন কাটত।ব্রাউনিং এর ভালবাসায় সিক্ত হয়ে চিররোগা ব্যারেট তখন সজীবতা ফিরে পায়।শুয়ে শুয়ে সে কবিতা লিখে নিজেকে ব্যস্ত রাখত।

১৮৪৪ সাল থেকেই এই দম্পতির প্রেম শুরু।তখন ব্যারেট সাহিত্যের অনেক উঁচুতে চলে গিয়েছিল।আর ব্রাউনিং ও শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে সমাদৃত হয়।

তাদের এই প্রেম যেন বাস্তবিক পক্ষেই অবিশ্বাস্য রকমের সত্যি।দুজন অপরিচিত মানুষের একমাত্র পরিচয় ছিল তাদের কবিতায়।দুজনই দুজনের প্রতি মুগ্ধ হয়েছিল এই কবিতার মাধ্যমে।প্রেমপত্রই ছিল তাদের প্রধান যোগাযোগ করার মাধ্যম।তাদের এই অসম প্রেম কালের গহ্ববরে হারিয়ে যায় নি; রবং চিরসাক্ষী হয়ে আমাদের মাঝে বেঁচে আছে। ১৫ বছরের দাম্পত্য জীবনে একদিনও তাদের বিচ্ছেদের কষ্ট ভোগ করতে হয় নি।প্রিয়তমা এলিজাবেথের মৃত্যুর পরও ব্রাউনিং তাকে ভুলে যাই নি।তার লেখায় এলিজাবেথ এখনো বেঁচে আছে, আজীবন থাকবে।

এলিজাবেথকে লেখা রবার্ট ব্রাউনিং এর প্রথম চিঠি-

প্রিয় মিস ব্যারেট,

আপনার কবিতাগুলো সারা অন্তর দিয়ে আমি ভালবাসি..আপনি হয়ত জানেন না।একবার আপনার সঙ্গে আমার দেখা হওয়ার উপক্রম হয়েছিল।আপনার আত্মীয় মি কিনিয়ন আমাকে প্রস্তাব করেছিলেন, "আপনি কি মিস ব্যারেটের সঙ্গে দেখা করবেন?" তারপর তিনি আমাদের দেখা করবার ব্যবস্থা করতে গিয়ে ফিরে এসে বললেন, আপনি নাকি তখন কাউকে সাক্ষাৎ দেবার মতো সুস্থ ছিলেন না।সে আজ কয়েক বছর আগের কথা।

সেদিনের কথা মনে পড়লেই আমার মনে হয়- যেন কোনো এক দূরদেশে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতেই আমি এমন এক জায়গায় এসে পড়েছিলাম,যেখানে একটি পরম বিস্ময় লুকিয়ে আছে একটি মাত্র পর্দার অন্তরালে।কিন্তু শুধু সামান্য একটু বাঁধার জন্যই যেনবা দরজাটা অর্ধেক খলে গিয়েও আবার বন্ধ হয়ে গেল।হাজার হাজার মাইল দুরে ফিরে এলাম আমি নিজের ঘরে, কিন্তু বিশ্বের সেই পরম বিস্ময়, তা আমার না দেখাই রয়ে গেল।..

-রবার্ট ব্রাউনিং

 

প্রেমিকার মৃত্যুর ২৮ বছর পর ব্রাউনিং অসুস্থ হয়ে মারা যান।সারাজীবন তিনি সাহিত্যের পেছনে ছুটেছেন, ভালবাসার পেছনে ছুটেছেন; নিজেকে সমর্পণ করেছেন।দিনশেষে তিনি মারা যায়; কিন্তু তার স্মৃতি আর ভাবনাগুলো এখনও অমর। ১৮৮৯ সালে ভেনিসে পুত্রের বাসায় ব্রাউনিং মারা যান।

পরিশেষে,

ব্রাউনিং এর কবিতা ছিল মূলত দিকবদলের কবিতা।অন্যান্য কবি- সাহিত্যিকরা যখন জীবনের দুঃখ- কষ্ট আর না পাওয়াগুলো নিয়ে হতাশা আর অভিযোগের কাব্য লিখত; ব্রাউনিং তখন সকল ব্যর্থতার মাঝেও খুজে ফিরতেন ভবিষ্যতের সম্ভাবনা আর আশার বাণী।তার চেষ্টা ছিল মানুষের মনের বিচিত্র গতিপ্রকৃতিকে তাদের জবানবন্দী মারফত ফুটিয়ে তোলার।

তার কবিতাগুলো পুরুষতন্ত্রকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে, ধর্মের ভন্ডামিকেও তিনি ছাড় দেন নি।মানবমনের সত্যগুলোকে তিনি যেভাবে উন্মোচন করেছেন, তা অবিস্মরণীয়।তার কবিতা গুলো ছিল বিচ্ছেদের মাঝেও এক টুকরো ভালবাসা।সর্বত্র তিনি প্রেমের জয়গান করেছেন, হৃদয়ের উষ্ণতাকে স্থান দিয়েছেন সবার আগে।তাই তো তিনি প্রেম, বিরহ ও বিচ্ছেদের কবি।

Read More:
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url