রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনী

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ,এক অপার সৃষ্টিশীল প্রতিভা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; অপার সৃষ্টিশীল প্রতিভার এক অনুপম সম্ভার।বাংলা সাহিত্যে তিনি একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র এবং তার বিশাল কীর্তির জন্য তিনি মানবশরীরের রক্তস্রোতে আজীবনকালের জন্য মিশে গেছেন।একাধারে কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, সংগীতজ্ঞ, সুরকার, চিত্রশিল্পী এবং নাট্যকার ছিলেন তিনি।এক কথায়, বহুমুখী প্রতিভার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত তিনি।তার লেখা প্রতিটি শব্দ যেন আমার-আপনার-সবার নিজস্ব অপ্রকাশিত অভিব্যক্তি।তার লেখা প্রতিটি শব্দে আমাদের শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ভালবাসা জাগ্রত হয়।

২৫ শে বৈশাখ, ১২৬৮ বঙ্গাব্দে কলকাতার ধনাঢ্য ও সংস্কৃতিবান জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বরেন্দ্র এই প্রতিভাবান মানুষটি।ঠাকুর বাড়ি ছিল সেই যুগে সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিল্পকলা ও সংগীতের পীঠস্থান।বাবা দেবেন্দ্রনাথ ও মা সারদা দেবীর পনেরো সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন চতুর্দশ।

শিশু রবীন্দ্রনাথের জীবনে তার ভাইদের প্রচুর অবদান ছিল, বিশেষ করে তার বড় চার ভাই।তার শিশু অবস্থায় জীবন কেটেছিল নিতান্তই সহজ-সরল-সাদাসিধে ভাবে ঝি-চাকরদের হেফাজতে।স্কুলে বা বিদ্যালয়ে গিয়ে পড়ালেখা করা রবীন্দ্রনাথের তেমন ভাল লাগত না।তখন থেকেই প্রথাগত শিক্ষা তিনি মেনে নেননি।স্কুলের বাধাধরার মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় ছোটবেলা থেকেই তার অনাগ্রহ ছিল।তাই বাসায় তাকে গৃহশিক্ষক রেখে পড়ানো শুরু করা হয়।

বাড়িতে ছেলেদের সববিদ্যায় পারদর্শী করবার জন্য বিচিত্র শিক্ষার আয়োজন করা হয়েছিল।গৃহশিক্ষকের কাছে বাংলা, ভূগোল, ইতিহাস পড়তেন রবীন্দ্রনাথ।যে অল্প কয়েকদিন তিনি স্কুলে পড়েছিলেন, স্কুলের দিনগুলো তার কাছে “মুখবিবরের মধ্যে প্রাত্যাহিক বরাদ্দ গ্রাসপিন্ডের মত” লাগত।

মাত্র আট বছর বয়সে তার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়।জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে ঘুরে বেড়াতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন তিনি। ১১ বছর বয়সে প্রথম তিনি মুক্তির স্বাদ পেলেন।বাবা দেবেন্দ্রনাথের সাথে কয়েকমাসের জন্য ভারতের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি।প্রকৃতির সাথে তখনই প্রথম পরিচয় ঘটে রবীন্দ্রনাথের।

প্রকৃতির মায়াভরা সান্নিধ্য থেকে ফিরে এসে রবীন্দ্রনাথের জীবনে নতুন এক অধ্যায়ের সূত্রপাত হয়।মুক্তভাবে তিনি ঠাকুর বাড়িতে সাহিত্যচর্চা শুরু করলেন। ১৮৭৪ সালে তার প্রথম মুদ্রিত কবিতা অভিলাষ প্রকাশিত হয়।এরই মাঝে ১৮৭৫ সালে মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে তিনি মাতা সারদা দেবীকে চিরদিনের জন্য হারান।তার পিতা দেবেন্দ্রনাথ তখন দেশভ্রমণের নেশায় অধিকাংশ সময় কলকাতার বাহিরে অতিবাহিত করত।একদিকে মাতার মৃত্যুশোক, অন্যদিকে পিতার উড়নচন্ডী স্বভাব তাকে সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ বাড়াতে সাহায্য করে।

১৮৭৭ সালে রবীন্দ্রনাথ ভানুসিংহ ছদ্মনামে লেখালেখি শুরু করেন।ধীরে ধীরে তার অনেকগুলো গ্রন্থ, কাব্য ও ছোটগল্প প্রকাশিত হতে থাকে। ১৮৭৮ সালে তার ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাকে ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য বিলাতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন।

নলিনী; রবীন্দ্রনাথের প্রথম প্রেম।সতের বছর বয়সে পা দেওয়া এক সদ্য কিশোর, যাকে পরিবার বিলাতে পাঠানোর কথা ভাবছিল।তখনই বয়সে তিন বছরের বড় অন্নপূর্ণা তর্খদ এর সাথে তার দেখা হয়।পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথ তাকে নলিনী নাম দেন।নলিনী সবেমাত্র বিলাত থেকে লেখাপড়া শেষ করে ফিরেছেন।ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ভাবলেন, অন্নপূর্ণার সাথে থাকলে রবীন্দ্রনাথ ইংরেজিতে দক্ষ হবে।সেই সুবাধে, দুজন মানব-মানবীর স্বল্প সময়ের মেলামেশা সাধারণ অনূভুতিকে ছাড়িয়ে অসাধারণত্বে রুপান্তরিত হয়।তাদের ইংরেজি দীক্ষা না হলেও মনের লেনাদেনার হিসেব ঠিকই হয়েছিল।কিন্তু সুখের পরে যেমন দুঃখ হাতছানি দিয়ে ডাকে; তেমনি রবীন্দ্রনাথের প্রথম প্রেমের সমাপ্তি হলো তার পরিবারের কারণে।কিন্তু তাদের প্রেম যে ক্ষণিকের আকর্ষণ ছিল না; তা রবীন্দ্রনাথের নলিনীকে নিয়ে লেখায় প্রকাশ পায়।

জীবনের শেষ সময়ে এসেও রবীন্দ্রনাথ এই অসম প্রেমের প্রেমিকাকে স্মরণ করেছেন, আজও তাকে জাগ্রত করে রেখেছেন তার লেখা কবিতায়।

“প্রহরশেষের রাঙা আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস,

তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ।“

-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

১৮৭৮ সালে প্রথম প্রেম-বিচ্ছেদের পর বিলাত যান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।ইংল্যান্ডে থাকাকালীন বিখ্যাত ইংরেজ সাহিত্যিকদের সাথে তার পরিচয় ঘটে।প্রথমে ব্রাইটনের একটি পাবলিক স্কুলে ভর্তি হলেও পরবর্তীতে তিনি আইনবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন।কিন্তু এসব পুঁথিগত পাঠ যে তার অনাগ্রহ, তার আগ্রহ যে সাহিত্যে।অবশেষে দেড় বছর ইংল্যান্ডে কাটিয়ে কোনো ডিগ্রি ব্যতীত দেশে ফিরেন তিনি।

সদ্য কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা দিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।রবীন্দ্রনাথের মনে তখন ভগ্ন হৃদয়ের আনাগোনা।যেখানে আত্মীয়-স্বজনের কটু বাক্যে তার ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা, সেথায় বৌঠান কাদম্বরী দেবী ছিলেন এক পশলা সান্ত্বনা।দশ বছর বয়সে ভাই জ্যেতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের বউ সেজে এসেছিল টুকটকে এই মেয়েটি।কিন্তু স্বামীর দৃপ্ত পদচারণার তুলনায় আপাতদৃষ্টিতে খানিকটা নিষ্প্রভই ছিলেন কাদম্বরী।স্বল্পভাষী, রহস্যময়ী, কোমল, সমবয়সী এই বৌঠানের কাছে রবীন্দ্রনাথ খুঁজে পেয়েছিল অপূর্বতার সমন্বয়।

একাধারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিচক্ষণ পাঠিকা, হৃদয়ের রাণী, খেলাঘরের সাথী ছিলেন কাদম্বরী দেবী।এমনকি রবীন্দ্রনাথ তাকে ডাকত গ্রীক দেবী হেকেটি নামে।তার অসাধারণত্বের পরিচয় মেলে রবীন্দ্রনাথের বৌঠানকে নিয়ে লেখা অজস্র কবিতায়, গানে।কবিগুরুর ব্যক্তিজীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিলেন তিনি।

মাত্র ২৫ বছর বয়সে আত্মহত্যা করেন কাদম্বরী দেবী।পরিবারের সবার দেওয়া উপহারস্বরুপ বিচ্ছেদের যন্ত্রণাকে আপন করে নিলেন তিনি।স্থির, সল্পভাষী, কোমল হৃদয়ের নারীটি ধৈর্য্যের শেকল ভেঙে রিক্ত হৃদয়ে, পাহাড় সমান অভিমান নিয়ে প্রস্থান করলেন।তার মৃত্যুর পর, পুরো কলকাতা শহরজুড়ে যেন গুজবের হাট চলতে থাকে।

হৃদয়ের রাণী, হেকেটির মৃত্যু রবীন্দ্রনাথের মনকে ভেঙে গুড়িয়ে দেয়।তিনি কাদম্বরী দেবীকে উৎসর্গ করে বই লিখল প্রকৃতির প্রতিশোধ।উৎসর্গ পত্রে লেখা ছিল-

“বহুকাল হইল, তোমার কাছে বসিয়াই লিখিতাম,

তোমাকেই শুনাইতাম।

তুমি যেখানেই থাক না কেন,

এ লেখাগুলি তোমার চোখে পড়িবেই।”

এ যেন অসংজ্ঞায়িত, অপ্রথাগত প্রেমের অসমাপ্ত সমাপ্তি।কিছুটা জটিল, কিছুটা সহজ এই প্রেমের কোনো সংজ্ঞা নেই।

১৮৮৩ সালে বৌঠান কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুর চার মাস আগে রবীন্দ্রনাথ বিয়ে করেন ঠাকুর বাড়ির অধীনস্ত কর্মচারীর ১০ বছরের কিশোরী মৃণালিনী দেবী কে।তাদের মোট পাঁচজন সন্তান ছিল।

১৮৯০ সালে রবীন্দ্রনাথ ভাইয়ের সাথে দ্বিতীয়বারের মত বিলাত ভ্রমণে যায়।এবং ১৮৯১ সালে পিতার আদেশে কুষ্টিয়ার শিলাইদহ, পাবনা, রাজশাহী ও উড়িষ্যায় পৈত্রিক জমিদারিগুলোর তদারকি শুরু করেন।শিলাইদহে পদ্মা নামক একটি বিলাসবহুল পারিবারিক বজরায় চড়ে নামমাত্র প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করতে যেতেন তিনি।

১৯০১ সাল পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিলাইদহে কাটিয়েছিলেন।সেখানে বসেই তিনি পত্নী মৃণালিনী দেবীকে নিয়মিত চিঠি লিখতেন।সেখানকার মানুষ, খাল-বিল, নদ-নদী, শষ্যক্ষেত, সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত; এমনকি শরতের আকাশে নদীর উত্তাল বুকের উপর শৈল্পিক বক্র রেখায় উড়ে যাওয়া পাখির ঝাঁক, সবই জায়গা করে নিয়েছিল তার লেখায়।

"মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে, 

মানবের মাঝে আমি বাঁচিবার চাই।

এই সূর্য করে এই পুষ্পিত কাননে জীবন্ত হৃদয়-

মাঝে যদি স্থান পাই।"

-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

ওই সময় তিনি তার গল্পগুচ্ছ বইয়ের প্রায় ৫০ টির মতো গল্প লেখেন।এসব গল্পে তিনি মূলত গ্রাম বাংলার দারিদ্রতা ও বঞ্চনার চিত্র তুলে ধরেছিলেন।সেখানে বসেই তিনি লিখেছিলেন তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ সোনার তরী, চিত্রা, ক্ষণিকা ও চৈতালির অসংখ্য কবিতা।

রবীন্দ্রনাথ ১৯০১ সালে শিলাইদহ থেকে আবারও শান্তিনিকেতনে ফিরে আসেন।সেবছর তিনি শান্তিনিকেতনে একটি স্কুল স্থাপন করেন।পরবর্তীতে যেটি বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রুপান্তরিত হয়।এবং এটি ১৯৫১ সালে ভারতের কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা লাভ করে।শান্তিনিকেতনে থাকাকালেই অল্প কয়েক বছরের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ তার স্ত্রী, এক পুত্র, এক কন্যা এবং পিতাকে হারান।

এসবের মাঝেই ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশী আন্দোলনে তিনি জড়িয়ে পড়েছিলেন।বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে যে রাজনৈতিক আন্দোলন দানা বেঁধেছিল, তার পুরোভাগে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।এ নিয়ে তিনি বঙ্গদর্শন পত্রিকায় তার মনোভাব ব্যক্ত করেন, এবং এর ঘোর বিরোধিতা করেন।সেই সময়ে রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য গান রচিত হয়; সেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ও ভারতের জাতীয় সংগীতও ছিল।

ধীরে ধীরে কবির সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। ১৯০১ সালে নৈবেদ্য ও ১৯০৬ সালে খেয়া কাব্যগ্রন্থের পর ১৯১০ সালে তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ গীতাঞ্জলি প্রকাশিত হয়। ১৯১২ সালে তিনি আবার ইংল্যান্ডে যান।সেখানে ইংল্যান্ডের অনেক কবি সাহিত্যিকদের সাথে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় হয়; তাদের মধ্যে কবি ইয়েটস অন্যতম।পরবর্তীতে কবি ইয়েটস গীতাঞ্জলি কে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন এবং সারা বিশ্বে রবীন্দ্রনাথের খ্যাতি বাড়িয়ে দেয়।

গীতাঞ্জলি এর ইংরেজি অনুবাদ বের হওয়ার পর ইউরোপ তাকে শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে গ্রহণ করে নেন। ১৯১৩ সালের নভেম্বর মাসে তিনি গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের জন্য নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত হয়।

১৯১৪ সাল থেকে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্মে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়।তিনি তার সাহিত্যকর্মে সারাবিশ্বে চলমান ঘটনা, রাজনীতি, অবৈজ্ঞানিক যুক্তিগুলো তুলে ধরা শুরু করলেন।ব্রিটিশ সরকার ১৯১৫ সালে তাকে নাইট উপাধিতে ভূষিত করেছিল।কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইংরেজ শাসকের প্রবর্তিত এক বিল; যার আওতায় বিনা বিচারে যেকোনো লোককে আটকে রাখার বিধান পাশ করা হয়েছিল।তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভকারী প্রায় দুহাজার নিরস্ত্র মানুষের উপর গুলি চালানো হয়েছিল, ব্রিটিশ সরকারের নির্দেশে।পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগে এ ঘটনার প্রেক্ষিতে, তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে ভাইসরয়কে এক পত্র লিখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাইট উপাধি প্রত্যাখান করেন।

সমাজ কল্যাণ, গ্রাম উন্নয়ন ও গ্রামের দরিদ্র মানুষের শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার পক্ষে তিনি সোচ্চার ছিলেন। ১৯২১ সালে শান্তিনিকেতনে পল্লী সংগঠন কেন্দ্র নামে একটি পল্লী উন্নয়ন কেন্দ্র গড়ে তুলেছিলেন।যা পরবর্তীতে শ্রীনিকেতন নাম রাখা হয়।এই সংস্থার উদ্দেশ্য ছিল কৃষির উন্নতি সাধন, সমবায় প্রথা চালু করা এবং গ্রামের সাধারণ মানুষদের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়ানো।এবং এবছরই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাকেই প্রথম জগত্তারিণী পদক প্রদান করে।

“আমি চিনি গো চিনি,

তোমারে ওগো বিদেশিনী।”

১৯২৪ সালে পেরুর স্বাধীনতা সংগ্রামের শতবর্ষপূর্তির অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পেরুর উদ্দেশ্যে সমুদ্রযাত্রা শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।কিন্তু মাঝপথে অসুস্থ হওয়ার কারণে তাকে আর্জেন্টিনায় অবস্থান করতে হয়।সেখানেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় আর্জেন্টাইন নারীবাদী লেখিকা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো এর সাথে।রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি এর অনুবাদ পড়েই তার প্রতি মুগ্ধ হয়েছিলেন তিনি।তিনি অসুস্থ হওয়ার খবর জানামাত্রই ছুটে আসেন রবীন্দ্রনাথকে দেখতে এবং থাকার জন্য আত্মীয়ের বাসায় নিয়ে যান রবীন্দ্রনাথকে।

এ যেন ত্রিশ অছর আগের লেখা আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী এরই প্রতিচ্ছায়া।ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে বিজয়া নামে ডাকতেন তিনি।তাকে উৎসর্গ করে বইও লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।আর্জেন্টিনার সেই আত্মীয়ের বাড়িতে তাদের দুইজনের একসাথে থাকা যেন জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় বলে মনে হয় রবীন্দ্রনাথের কাছে।একসাথে কবিতা পড়া, নদী দেখা, অবিস্রান্তভাবে আড্ডা দেওয়ার এই প্রেম যেন মুক্ত, শেকলবিহীন।

রবীন্দ্রনাথের পুরো জীবনে ভিক্টোরিয়ার সাথে দুইবার দেখা হয়েছিল। ১৯২৪ সালে আর্জেন্টিনায়, আবার ১৯৩০ সালে প্যারিসে।কিন্তু তাদের প্রেম যে দুরত্ব মানে না, চিঠি-টেলিগ্রামেই তাদের প্রেম আদান-প্রদান হত।

রবীন্দ্রনাথের জীবনে বহু প্রেম ছিল।কিন্তু বিদেশিনীর সাথে নিষ্কাম এই প্লেটোনিক প্রেমের কোনো তুলনা নেই।নিজেদের ভালবাসা স্মরণ রাখতে দুজনই লেখেন দুজনাকে নিয়ে।মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ভিক্টোরিয়া রবীন্দ্রনাথের খবর নিয়েছে, নিয়মিত যোগাযোগ করেছে।

রবীন্দ্রনাথ-ওকাম্পোর এই প্রেমকে কোনোভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায় না।বিরল এই প্রেম ইতিহাসের পাতায় চিরজীবনের সাক্ষী হয়ে থাকবে।

১৯৩০ সালে তিনি একাধিক বক্তৃতা, গান ও কবিতায় ভারতীয় সমাজের বর্ণাশ্রম প্রথাঅস্পৃশ্যতার তীব্র সমালোচনা করেছিলেন।

গাছ বেড়ে ওঠার পর গাছের ছায়ায়

তার আর কোনোদিন বসা হবে না

এটা জেনেও যে গাছ লাগায়, 

সে অন্তত জীবনের অর্থ বুঝতে শুরু করে দিয়েছে।

-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। 

জীবনের শেষ দশকে রবীন্দ্রনাথের মোট পঞ্চাশটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।তাছাড়া তার সাহিত্যসম্ভারে মোট ৫২ টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮ টি নাটক, ১৩ টি উপন্যাস, ৩৬ টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য আরো অনেক সৃষ্টিশীল কাজ রয়েছে।

মাত্র ৭০ বছর বয়সে তিনি ছবি আঁকতে শুরু করেন।প্রথাগত কোনো শিক্ষা ব্যতীত তিনি প্রায় দুহাজার ছবি এঁকেছিলেন।

জীবনের শেষ চার বছর ছিল তার ধারাবাহিক শারীরিক অসুস্থতার সময়।মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি তার সাহিত্যকর্ম অব্যাহত রেখেছিলেন।অবশেষে, দীর্ঘ রোগভোগের পর ১৯৪১ সালে তার অতুলনীয় প্রতিভা আমাদের দিয়ে গিয়ে তিনি অন্ধকারে হারিয়ে যান চিরদিনের জন্য।

রবীন্দ্রনাথকে অনেকে বলে প্রেমের কবি।তার প্রতিটা লেখায় লুকিয়ে আছে প্রেম, বিরহ, ব্যকুলতা আর নিঃসঙ্গতার এক মহা উপাখ্যান।একইভাবে, তার ব্যক্তিজীবনেও প্রেম এসেছিল বহুভাবে, বহুমাত্রায়।স্ত্রী ছাড়াও তার লেখায় একাধিক নারী চাপ ফেলেছিল।

কখনও বা বয়সে বড় অন্নপূর্ণা ওরফে নলিনীর সহিত প্রেম।তাদের এই অসম প্রেম যে সাময়িক আকর্ষণ ছিল না তা নিঃসন্দেহে বোঝা যায়।কিন্তু ভাগ্য যে নির্মমভাবে বিচ্ছিন্ন করেছিল তাদের।

নলিনী ছিল তার যৌবনের প্রথম প্রেম।কিন্তু যার কথা না বললেই নয়; সে কাদম্বরী দেবী।বৌঠান কাদম্বরী দেবীর সাথে রবীন্দ্রনাথের প্রেমের সম্পর্ক যেন অন্তরালের কাব্যের মত।কখনও তা প্রকাশ পায় নি, এমনকি নিষ্ঠুর আত্মহননের পরও মাটিচাপা হয়েছিল এই কাব্য।প্রথাগত প্রেমকে ছাড়িয়ে অপূর্ণ এই প্রেম রবীন্দ্রনাথ কখনো ভুলতে পারেনি।রবীন্দ্রনাথ কাদম্বরী দেবীকে নিয়ে অনেক কবিতা লিখেছে।এমনকি ১৯৬৪ সালে সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ফিল্ম চারুলতা; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বৌঠানকে নিয়ে লেখা নষ্টনীড় অবলম্বনে তৈরি করা হয়েছে।এছাড়া ২০১৫ সালে সুমন ঘোষ পরিচালিত কাদম্বরী নামের একটি মুভিও তৈরি হয়েছে।

তাছাড়া আর্জেন্টাইন নারীবাদী লেখক ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোও রবীন্দ্রনাথকে নিয়েও অনেক কবিতা, গান লিখেছিল।ওকাম্পোও লিখেছিল, Tagore en Las Barrancas de San Isidro. তাছাড়া রবীন্দ্রনাথের বায়োপিক Thinking of Him সিনেমায় উঠে এসেছে তাদের অসম প্রেমের গল্প।

“পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দূরত্ব কোনটি জানো?

নাহ, জীবন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত,

উত্তরটা সঠিক নয়। 

সবচেয়ে বড় দূরত্ব হলো যখন আমি তোমার সামনে থাকি, 

কিন্তু তুমি জানো না যে আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি।”

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাব্যসাহিত্যের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তার ভাবগভীরতা, আধ্যাত্মিক চেতনা, সৌন্দর্যচেতনা।এছাড়া তার সাহিত্যে বিশ্বপ্রেম ও মানবপ্রেমের পাশাপাশি প্রকৃতিপ্রেম, রোমান্টিক সৌন্দর্যচেতনা আর প্রগতিবোধ প্রকাশ পেয়েছে।তাছাড়া তিনি তার লেখায় সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতি সম্বন্ধেও তার মতামত তুলে ধরেছিলেন।তার সবচেয়ে বিখ্যাত এবং উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ গীতাঞ্জলি।এছাড়াও নৌকাডুবি, চোখের বালি, গোরা, ঘরে বাইরে, শেষের কবিতাসহ মোট ১৩ টি উপন্যাস রচনা করেছিলেন তিনি।

রবীন্দ্রনাথের সংগীতের কথা না বললেই নয়।বিদেশী গানের সুর ও রীতি অবলম্বনে রচিত আছে তার অজস্র কালজয়ী সব গান। ১২ বছর বয়স থেকে তিনি গান রচনা শুরু করেন।তাল-লয়-সুরের ভারে নীত বাংলা গানকে ভেঙে সুন্দর, সহজ ও সাবলীলভাবে সাধারণের কাছে পৌছে দিয়েছেন তিনি।তার উল্লেখযোগ্য কিছু গান হলো- আমি চিনি গো চিনি তোমারে, ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে, পুরানো সেই দিনের কথা ইত্যাদি।

রবীন্দ্রনাথ শুধু যে নিজের দেশে বসেই সাহিত্যসৃষ্টি করেছিলেন তা কিন্ত নয়; তিনি সারা বিশ্ব ঘুরে বেরিয়েছেন।ত্রিশটিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেন রবীন্দ্রনাথ।এবং সেখানে অনেক বিখ্যাত সাহিত্যকর্মের সাথেও তার পরিচয় ঘটে; পরবর্তীতে যা তার লেখায় প্রভাব ফেলে।তাছাড়া রবীন্দ্রনাথের লেখা ইংরেজি, ডাচ, জার্মান, স্প্যানিশসহ বেশ কিছু ইউরোপীয় ভাষায় অনুদিত হয়েছিল।তার সমসাময়িক অনেক কবি, সাহিত্যিক তাকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছিল।

পরিশেষে,

আজও গভীর দার্শনিক জীবনবোধ সম্পন্ন এই মানুষটি আমাদের রক্তের শিরায় শিরায় চির-ভাস্বর হয়ে আছেন।হয়তো ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ কালের গহ্বরে হারিয়ে গেছেন; কিন্তু তিনি আজও তার অনুপম প্রতিভাশিল্পের কারণে আমাদের মাঝে বেঁচে আছেন, সবসময় থাকবেন।


আজ এই পর্যন্ত ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনী।

Read More: