জালাল উদ্দিন রুমি; হৃদয়ের কাঙ্ক্ষিত কথক
Jalaluddin Rumi
কোনটা ভাল আর কোনটা মন্দ?
এই দুইয়ের মাঝে রয়েছে আরেকটি জগৎ।
আমি তোমার সাথে সেখানেই দেখা করবো প্রিয়।
-রুমি।
মানবাত্মাকে শান্তিময় করার জন্য ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে যার কবিতার অমোঘ বাণী আজও হৃদয়ে গেঁথে আছে তিনিই বিখ্যাত আধ্যাত্মিক সুফিবাদের গুরু মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি।বর্তমান বস্তুবাদী যান্ত্রিকতার নগরীতে যেখানে মনুষ্য সমাজ হত্যা,প্রতিহিংসা,প্রতিশোধে কলুষিত সেখানে কবিতারুপে শান্তিময় প্রেমের অমিয় বার্তা তৃষ্ণার্ত মানবাত্মার মুখে যেন অমৃত সুধা।সর্বজনীন মানবতার কবি জালালুদ্দিন রুমি যেন কাঙ্ক্ষিত হৃদয়ের শান্তির বার্তা,আত্মার বাঁশিবাদক।তার কবিতার অমিয় বাণী যেন তপ্ত মরুর বুকে তৃষ্ণার্ত যাযাবরের মুখে শান্তির পরশ।রুমি তার কবিতায় সুরের মূর্চ্ছনায় আত্মার অন্তঃস্তলে যে অপূর্ব দ্যোতনা সৃষ্টি করেছেন বিশ্ব সাহিত্যে আর কোনো কবির কবিতায় তার তুলনা আছে বলে আমাদের জানা নেই।
১২০৭ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ সেপ্টেম্বর পারস্যের খোরাসান প্রদেশের বালখ শহরে জন্মগ্রহণ করেন মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি।বাবা বাহা উদ্দিন একজন সুপরিচিত আলেম ও আইনজ্ঞ ছিলেন।মা মুইমিনা খাতুনও সম্মানিত ব্যাক্তি ছিলেন।তখনকার সময়ে বালখ শহর ছিল সুফি চর্চার কেন্দ্রবিন্দু।তাছাড়া পিতার ধার্মিক মনোভাব রুমির বেড়ে ওঠার পিছনে বিস্তর প্রভাব ফেলে।
রুমির শৈশবকাল ছিল বিচিত্রতায় ভরা।কথা-বার্তা,আচার-আচরণ,লেখা-পড়া ইত্যাদি সবকিছুতেই রুমি অন্যান্য বাচ্চাদের তুলনায় আলাদা ছিলেন।শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন জ্ঞানুরাগী।যদিও তার শৈশবের ঘটনা খুব একটা জানা যায় না।রুমির ৫ বছর বয়সে তার পিতা বাহা উদ্দিন বালখ শহর ত্যাগ করে কুনিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।সেখানে পারস্যের বিখ্যাত কবি "ফরিদুদ্দিন আত্তার" এর সাথে তার সাক্ষাৎ ঘটে।রুমিকে পারস্যের এই বিখ্যাত কবি "আসারনামা" নামক ইহলৌকিক গভীরতা সম্পন্ন একটি বই উপহার দেন।কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন রুমি এই বইয়ের মর্ম বুঝবে।পরবর্তীতে "আসারনামা" রুমির কিশোর বয়সে গভীর প্রভাব ফেলে এবং তিনি রহস্যের উপর আকৃষ্ট হন।তখন থেকেই রুমির আধ্যাত্মিকতা ধীরে ধীরে সবার সামনে উন্মোচিত হতে শুরু করে।
ভেবে দেখ,যা কিছুই তুমি ভালবাসো
যা কিছু খোঁজো-তুমি তাই।
-রুমি।
১২২৫ খ্রিষ্টাব্দে রুমি গওহর খাতুনকে বিবাহ করেন।গওহর খাতুন মারা গেলে তিনি পুনরায় বিবাহ করেন।এবং সুলতাম ওয়ালাদ,আলাউদ্দিন চালাবী,আমির আলিম চালাবী ও মেয়ে মালাখী খাতুনের বাবা হন।
১২২৮ সালে আনাতোলিয়ার শাসক রুমির পুরো পরিবারকে আনাতোলিয়ায় বসবাসের অনুরোধ করেন।তারা সেখানে বসবাস শুরু করলে পিতা বাহা উদ্দিন স্থানীয় এক মাদ্রাসায় প্রধান শিক্ষক পদে নিযুক্ত হন।পিতা ইন্তেকাল করার পর রুমি সেই দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং সবার কাছে তখন থেকেই তার জ্ঞানের মাধ্যমে সমাদৃত হতে থাকেন।ধীরে ধীরে সবাই রুমির জ্ঞানের আলোয় বিকশিত হতে শুরু করে।
রুমির জগদ্বিখ্যাত হৃদয় নাড়িয়ে দেওয়া চিন্তা-ভাবনা এমনি এমনিতেই সৃষ্টি হয়নি।এর জন্য তার পাড়ি দিতে হয়েছে বিস্তীর্ণ কাটার পথ,তবেই তো দেখা পেয়েছে সুবাসিত গোলাপ।জ্ঞানের প্রতি প্রচুর জানার আকাঙ্ক্ষায় তাকে নিয়ে গেছে জ্ঞানের সর্বোত্তম স্থানে।যেখানে তিনি সমাদৃত হয়েছেন পদে পদে।
মোমবাতি হওয়া সহজ কাজ নয়,
আলো দেয়ার জন্য প্রথমে নিজেকে পুড়তে হয়।
-রুমি।
১২৪৪ খ্রিষ্টাব্দে রুমির জীবনে মোড় ঘোরানো পরিবর্তন আসে।স্বাধীন চিন্তার অধিকারী আধ্যাত্মিক সুফিগুরু "শামস তাবরিজি" এর সঙ্গে রুমির মোলাকাত হয়।সচ্ছল,আর্থিক অবস্থা ভাল সম্পন্ন রুমির সাক্ষাৎ ঘটে লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা কিছুটা ভবঘুরে "শামস তাবরিজি" এর সাথে।তিনি বেশিদিন এক জায়গায় অবস্থান করতেন না।তাই মানুষ তাকে "পাখি" বলে ডাকত।তাবরিজির সঙ্গে রুমির সাক্ষাতের পর তার চিন্তা,কর্ম,জীবনধারায় অর্থাৎ সবক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে।তিনি সব পরিত্যাগ করে তাবরিজির সাথে একান্তে সময় কাটাতে থাকেন।"শামস তাবরিজি" ও রুমির মধ্যে কম বয়সে জ্ঞানের বিশালতা আর গভীরতার আভাস পান।তাবরিজির সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় রুমি অন্য জগতের সন্ধান পায়।তিনি তার গতানুগতিক কর্মপদ্ধতি পরিহার করে তাবরিজির সাথে আধ্যাত্মিক আলোচনায় মগ্ন থাকতেন,একান্তে সময় কাটাতেন।তারা নিজেদের আলাপের মধ্য দিয়ে জ্ঞানের গভীরে প্রবেশ করতে থাকে।
স্রষ্টার কাছে পৌছানোর অজস্র পথ আছে।
তার মাঝে আমি প্রেমকেই বেছে নিলাম।
-রুমি
কিন্তু রুমির সাথে তাবরিজির এই সম্পর্ক সমাজের মানুষ মেনে নিতে চায় নি।সমাজে প্রতিষ্ঠিত একজন সম্মানিত ব্যাক্তির সাথে সমাজ বহির্ভূত এক ভবঘুরের সম্পর্ক তারা মানতে নারাজ।যদিও "শামস তাবরিজি" জ্ঞানের আলোয় আলোকিত এক নক্ষত্র,কিন্তু সাধারণের কাছে তিনি একজন নিঃস্ব ছাড়া কিছুই নয়।
কিন্তু সমাজের অধিকাংশ বানানো নিয়ম,বন্ধন রুমিকে আটকে রাখতে পারেনি।তিনি তাবরিজির সঙ্গে সময় কাটাতে অপ্রতিরোধ্য হয়ে যান।গুরু শিষ্যের মতো তাদের অভ্যন্তরীণ আধ্যাত্মিক ভালবাসাময় আলাপ-বার্তা বাতাসে নেচে বেড়াতে থাকে।ঐতিহাসিকদের মতে,"শামস তাবরিজি" কে হত্যা করা হয়।সে যাই হোক,তিনি আবার সেই বনের ভবঘুরে "পাখি" হয়ে যায় বা হারিয়ে যায় চিরতরে।
তাবরিজির হারিয়ে যাওয়ার অনেক দিন পর্যন্ত রুমি তাকে পাওয়ার আশায় বিভোর ছিল।তিনি তখনও বিশ্বাস করতে পারেননি তাবরিজি মারা গেছেন।
আমি কেন তাকে খুঁজব?
সে আর আমি তো একই
তার অস্তিত্ব আমার মাঝে বিরাজ করে
আমি নিজেকেই খুঁজছি।
-রুমি।
তাবরিজিকে হারিয়ে ফেলার শোকে রুমি লিখলেন "দেওয়ান-ই-শামস-ই-তাবরিজ"।এই বিখ্যাত গ্রন্থে তিনি হৃদয়ের আলো-অন্ধকার,সুফিবাদ,মানুষে-মানুষে সম্পর্ক এমনভাবে বলতে থাকেন যে এসব আগে কেউ শোনে নি।এ যেন বিচ্ছেদের সাগরে ডুবে থাকা অন্য রুমি।একে একে আধ্যাত্মিক কাব্য,কবিতা,গজল যোগ করতে থাকেন তার গ্রন্থ "দেওয়ান-ই-শামস-ই–তাবরিজ" এ।এই গ্রন্থে তিনি তার দার্শনিক বক্তব্যকে অত্যন্ত সহজ-সরল প্রাঞ্জলভাবে উপস্থাপনের জন্য নানা গল্পের অবতারণা করেছেন।প্রত্যেকটি অক্ষরই মানব হৃদয়কে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ভাবাতে থাকে।
সভ্যতায়-সভ্যতায়,জাতিতে-জাতিতে মানুষ যখন স্বার্থের দ্বন্ধে জর্জরিত তখন রুমি যেন একটু ভালবাসা,একটু সৌহার্দ্য,একটু প্রশান্তি নিয়ে নতুন মানুষরুপে পৃথিবীতে অবতারণা করেন।রুমি দিন দিন নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে থাকলেন,আরও দুর্বার,আরও দুরন্ত হয়ে ওঠলেন।তার লেখায় তা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়ে ওঠতে লাগল।
কণ্ঠকে নয়,শব্দকে তুলে ধর
মনে রেখো-ঝড় নয়,
বৃষ্টিতেই ফুল বেড়ে উঠে।
-রুমি
রুমির জীবনে তাবরিজির পর গুরুত্বপূর্ণ অনেকেই এসেছিলেন।তার মধ্যে শেখ সালাহুদ্দীন, হুসামুদ্দীন চেলপীর অন্যতম।তবে কেউই বেশিদিন আলোকিত ছিলেন না,অন্ধকার টেনে নিয়ে গিয়েছিল।কিন্তু ততদিনে রুমি সম্পর্কের বন্ধন থেকে অনেক উপরে ওঠে গিয়েছিলেন।প্রেম,বিরহ নিয়ে হঠাৎ করেই তিনি লিখতে বসেন আরেক বিস্ময়কর গ্রন্থ "মাসনবী শরিফ"।
"মাসনবী শরিফ" এর মূল প্রসঙ্গ মূলত প্রেম।প্রেমকে তিনি বিশ্বের আত্মা বলে অভিহিত করেছেন।প্রেমই বিশ্বের সৃষ্টি,প্রেমই তার স্থিতি।প্রেমই জীবনের নিগুঢ়তর রহস্য।রুমির আধ্যাত্মিক দর্শনের মূল বিষয় প্রেম।এই প্রেমই ধ্বনিত হয়েছে রুমির সমস্ত রচনায়,সমস্ত চেতনায়,চিন্তা দর্শনে।রুমির মতে প্রেম হচ্ছে,
কারো সাথে অথবা কোনো সত্ত্বার সাথে আবেগপূর্ণ সম্পর্ক।
এছাড়া রুমি প্রত্যেকটি লেখায় ছোট ছোট হেকায়েত বা গল্পের মাধ্যমে,গল্পের প্রতীকী চরিত্রে মাধ্যমে,ইশারা ইঙ্গিতে তার তত্ত্ব ব্যক্ত করেছেন।যার ফলে তা মানুষের কাছে অতি বোধগম্য হয়েছে।তার প্রতিটি শব্দ যেন ভাষা নয়,মানুষের হৃদয়ের স্পন্দনের অনুবাদ।
মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি আসলে এমনিই ছিলেন।তাইতো মানুষ তাকে তার মৃত্যুর পরও স্মরণ করে।রুমির মৃত্যুর পর জর্জিয়ার রাণী তার সমাধিস্থল নির্মাণ করতে তহবিল প্রদান করেন।যার ফলে কোনিয়ায় তার সমাধিস্থল নির্মাণ করা হয়।
মাওলানা রুমির চিন্তা-চেতনাগুলোকে কোনো নির্দিষ্ট ছাঁচে ফেলা সভব নয়।এরা নিজেদের মাঝেই অনেক সময় বৈচিত্র্য ও পার্থক্য সৃষ্টি করে।স্থান,কাল ও সংস্কৃতির সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে রুমির কবিতা তার চিরন্তন গ্রাহ্যতা প্রমাণ করে।আত্মার বিরহ-ব্যাথার বাঁশির সুরেই আত্মাকে পরিতৃপ্ত করার প্রয়াস চালিয়েছেন রুমি।রুমির "সুফিনৃত্য" আজও সারা দুনিয়াব্যাপী প্রচলিত।সৃষ্টির স্রষ্টার প্রতি হারিয়ে যেতে এই নৃত্য যেন অপূর্ব সুযোগ।
জলের কণাকে যেতে দাও,
মিশতে দাও সমুদ্রে,
যেখান থেকে তা এসেছে।
-রুমি।
পরিশেষে,মানুষ খুব বেশি কিছু হলে একটি ইতিহাস নয়,রুমি হয়েছেন এক জীবন ব্যবস্থা,ভাবনার পরিপূর্ণতা,আজও প্রত্যেকটি মানব হৃদয়ে তার নাম জ্বলজ্বল করছে,আজও তিনি স্মরণীয়।রুমি মানুষের মনের কাছাকাছি যেতে পেরেছিলেন,মনের অস্থিরতা প্রশমিত করার মুলমন্ত্র রুমি জানতেন।তাই মানুষের খন্ডত্ব বা একাকিত্বের অবসান ঘটিয়ে অখন্ড ও চিরন্তন স্রষ্টার সাথে সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে রুমির কবিতা ও চিন্তা-দর্শন সংযোগ সেতু হিসেবে পথ করে দিয়েছে।বাঁশি হয়ে সুর তুলেছে আত্মার একাকীত্বের শূণ্যতার নৈঃশব্দে।
ভাষাকে থামাও এখন
খুলে দাও তোমার বুকের মাঝখানের জানালা
আত্মা উড়ে বেড়াক সর্বত্র।
-রুমি।
Read More: