চারুলতা;সত্যজিৎ রায়ের অমর সৃষ্টি

চারুলতা;সত্যজিৎ রায়ের অমর সৃষ্টি

চারুলতা;সত্যজিৎ রায়ের অমর সৃষ্টি

সত্যজিৎ রায়ের সব সিনেমাতেই একটা অসাধারণত্ব এবং মুগ্ধতা রয়েছে।তিনি মানুষটাই এমন।স্বাভাবিকভাবে মানুষ সিনেমার চেয়ে লেখার প্রতি আকৃষ্ট থাকে,কিন্তু এই মহান পরিচালক যখন তা সেলুলয়েডের ফিতায় যুগলবন্দী করেন নির্দ্বিধায় তা লেখাকেও ছাড়িয়ে যাবে।তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণে প্রথম উদ্বুদ্ধ হন ইতালীয় নব্য বাস্তবতাবাদী চলচ্চিত্র "দ্য বাইসাইকেল থিফ" দেখে।বুঝাই যাচ্ছে ওনার সিনেমায় ভিন্ন মিশেলের কিছু থাকবে।এখন তাহলে সিনেমার দিকে নজর দেয়া যাক-


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "নষ্টনীড়" অবলম্বনে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছিলেন সত্যজিৎ রায়।অবলম্বন বললে ভুল হবে,ওনার নিজস্বতায় এই চলচ্চিত্রকে অভিভূত করেছে। ১৯৬৪ সালে নির্মিত এই সিনেমাটি তখনকার সময়ের সম্রান্ত-মুক্তমনা পরিবারগুলোর একটা আবহ তৈরি করে।তিনি অত্যন্ত নিপূনভাবে এতে মানব-সম্পর্ক,মনোদৈহিক দ্বন্ধ এককথায় মানবজীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশকে তুলে ধরেছেন।

চারুলতা;নামতার মধ্যেই কিছু আছে।মুগ্ধ করার মতো,অভিভূত করার মতো।চারুলতা তার নামের মতোই নিঃসঙ্গ একজন স্ত্রী,যে সারাদিন অন্দরমহলে বসে থাকে।কখনো সুই-সুতো নিয়ে সেলাই,কখনো বা পিয়ানোতে টুংটাং,কখনো লুকিং গ্লাসে এক বুক শূণ্যতা নিয়ে স্বামীকে দেখা।তার স্বামী ভূপতি,পেশায় আইনজীবী।তার চিন্তাভাবনা সবটা যেন সংবাদপত্রকে ঘিরে।প্রচন্ড রাজনীতি সচেতন এই ব্যাক্তি বাড়িতেই "Sentinnel" নামক ইংরেজি পত্রিকা প্রকাশ করেন।তার ধ্যান ওটাতেই সীমাবদ্ধ ছিল।কিন্তু স্ত্রীর প্রতিও তিনি অসচেতন ছিলেন না।এই খেয়ালী মানুষটার প্রতি চারুলতার যে গভীর শ্রদ্ধা ছিল,তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।তাদের দুজনের মধ্যে আসলেই শ্রদ্ধা আর সম্মান ছিল।চারুলতার সাহিত্য প্রতিভার হালকা প্রমাণ পেয়ে অমলকে তা জাগানোর দায়িত্ব দেয়া ভুপতির মনোভাবকে উদার করে দেয়।এমনকি,চারুলতার একাকীত্ব দুর করার জন্য তার দাদা উমাপদ ও স্ত্রী মন্দাকিনীকে আসতে বলে।কিন্তু চারুলতার এতে নিঃসঙ্গতা তো কাটেইনি উল্টো মন্দাকিনীর উচ্চবাক্যে বড্ড বিরক্ত লাগত তার।

হঠাৎ করে ঝড়ের রাতে ঝড়ের মত দমকা হাওয়ায় উড়ে আসার মতো উপস্থিত হয় প্রাণোচ্ছল এক ছেলে,অমল।তার আগমন যেন ঝড়ের মতোই সব পাল্টে দেয়,এমনকি চারুর একাকীত্বকেও।সদা হাস্য,ছেলেমানুষ এই দেবরের বৌঠানের প্রতি দুর্বলতা ছিল কিনা তা বলা মুশকিল।ভূপতির আদেশে চারুর সাহিত্যের প্রতিভা উন্মোচনের ভারে তাকে বরঞ্চ বিরক্তই দেখায়।কিন্তু চারু আর অমলের মধ্যে দীর্ঘ বন্ধুত্বের আভাস পাওয়া যায়।বাগানের মাঝে অমল যখন দাদার কথায় চারুলতাকে সাহিত্যচর্চা করাতে ব্যস্ত,চারু তখন দোলনায় বসে “ফুলে ফুলে,দুলে দুলে”গেয়ে সুই-সুতো দিয়ে স্বপ্ন বুনছে।অজানায় অমলের প্রতি তার আগ্রহ সৃষ্টি হয়।

[ফুলে ফুলে দুলে দুলে” গানটিই প্রথম আমাকে রবীদ্রসংগীতের প্রতি আকৃষ্ট করেছিল।দোলনায় বসে চারুর গলায় এতটা পারফেকশন আগে কোথাও দেখেনি।বোধহয় এটা ওই দৃশ্যের জন্যই সৃষ্টি হয়েছিল।]

অমলের এই ছেলেমানুষী প্রকট দায়িত্ববোধের মধ্যে পড়ে যখন সে বুঝতে পারে,চারুলতার তার প্রতি আলাদা অনূভুতি।দায়িত্ববোধের জের ধরেই রাতের আধারেই চিঠি লিখে চলে যায় সে।যাওয়ার সময় বৌঠানের দেয়া জতোজুড়ো ও নেয় না,যেন সব স্মৃতির সমাপ্তি।


শেষ দৃশ্যে, চারুর অমলের চিঠি পেয়ে কেদে উঠা ভূপতিকে তীব্র অনুশোচনাতে ভোগায়।তাদের দু-হাতের মধ্যবর্তী দুরত্ব যেন আর এক হয়না।নীড় ভাঙা পাখির মতোই,রবীন্দ্রনাথের "নষ্টনীড়" ভেসে উঠে পর্দায়।এক মধ্যকার শূন্যতা যেন শূ্ন্যেই থেকে গেল।মোহময় আবেগের এক অসাধারণ পূর্ণতা-বিচ্ছেদের দ্বন্ধের মধ্যেই সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা শেষ হল।এটাকে শেষ বললে ভুল হবে।তার অসাধারণ এই স্বকীয়তা অনুভবেই বিশ্বাসী।এটি অনন্য অনুভবের, এই গল্প অন্যরকম প্রেমের,এই গল্পের শেষ নেই।সত্যজিৎ রায় শেষ দৃশ্যে এটাই যেন বুঝাতে চায়।


এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “এটিই একমাত্র চলচ্চিত্র যা আজও বানালেই ঠিক এভাবেই বানাতাম।”

পরিশেষে,মানুষের মনস্তত্বের এক বিরাট দ্বন্ধ এই চলচ্চিত্রে দেখা যায়।নিঃসঙ্গ,একাকী বধুর হঠাৎ করে আগ্রহের বিষয় নিয়ে কাজ করা দেবরের প্রতি অনূভূতি যেন অন্যরকম এক মিশেল।সেলুলয়েডের ফিতায় সত্যজিৎ রায়ের এই রুপ রবীন্দ্রনাথের কাব্যময়তাকেও অবলীলায় ছাড়িয়ে গেছে।



Read More: